উৎপল বড়ুয়া, সিলেট প্রতিনিধি
সিলেট বিভাগের চার জেলার মধ্যে সর্বোচ্চ কোভিড-১৯ আক্রান্ত ও মৃত্যুর তালিকায় রয়েছে সিলেট জেলা। স্বাস্থ্য বিভাগ, সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের সর্বশেষ তথ্য গতকাল বুধবার পর্যন্ত বিভাগের চার জেলার ৩৬৩১ জন আক্রান্তের মধ্যে শুধু সিলেট জেলায়ই আক্রান্তের সংখ্যা ১৯৪৪ জন। পাশাপাশি আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণকারী ৬০ জনের মধ্যে একাই সিলেট জেলায় ৪৬ জন। করোনা ভাইরাস রোধে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ জোরালো ও সুষ্ঠুভাবে সিলেটে বাস্তবায়িত হচ্ছে না মর্মেও সিলেটে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে অভিযোগ উঠেছে। সিলেটের সচেতন নাগরিকবৃন্দ বলছেন, সিলেট নগরীর প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ড ও জেলা পর্যায়ে সকল উপজেলার কোনো না কোনো এলাকা রেড জোনে পড়েছে। এসব এলাকায় দিনরাত লোকজন অবাধে চলাফেরা করছে। কিন্তু, স্থানীয় প্রশাসন এক্ষেত্রে আশ্চর্যজনকভাবে নীরবতা পালন করছে। কোভিড-১৯ পরীক্ষা ছাড়াই অসংখ্য মানুষ আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের একটি মাত্র ল্যাবে প্রতিদিন সর্বোচ্চ ১৮৮টি নমুনা পরীক্ষা হয়। সিলেটে এক সপ্তাহ ধর্ণা দিয়েও করোনা পরীক্ষা করাতে পারছে না উপসর্গে ভোগা মানুষ। যারা নমুনা জমা দিচ্ছেন তাদের ফলাফল পেতে সময় লাগছে ১৫ দিন পর্যন্ত। শহীদ ডা: শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালে রোগীর চাপ বেড়ে যাওয়ায় উপসর্গ নিয়ে আসা নতুন কোনো রোগী ভর্তি করা হচ্ছে না। খাদিমপাড়া ৩১ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল ও দক্ষিণ সুরমা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং নগরীর আবুল মাল আবদুল মুহিত ক্রীড়া কমপ্লেক্সে আইসোলেশন সেন্টার স্থাপন করার উদ্যোগ নিলেও সেগুলোতে এখনও ভর্তি কার্যক্রম শুরু হয়নি। সিলেটের করোনামহামারির ভয়াবহ এই চিত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ওয়াকিবহাল করা হচ্ছে না উল্লেখ করে সিলেটের সর্বস্তরের নাগরিকের পক্ষে গতকাল বুধবার জেলা প্রশাসক এম. কাজী এমদাদুল ইসলামের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবরে স্মারকলিপিটি প্রদান করা হয়েছে। স্মারকলিপিতে উল্লিখিত বিষয়ে আলোকপাত করা হয়। স্মারকলিপিতে প্রধান তিনটি দাবির মধ্যে রয়েছে-সংক্রমণ রো:ে জনসাধারণের বেপরোয়া চলাচল ঠেকাতে এখই লকডাউনের মতো কঠোর পদক্ষেপ, নতুন পিসিআর ল্যাব স্থাপন এবং চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য নিরাপদ আবাসনের ব্যবস্থা করা। স্মারকলিপিতে বলা হয়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমরা সচেতন সিলেটবাসী এবং সিলেটের প্রতিনিধিত্বশীল বিভিন্ন সংগঠনের দায়িত্বশীল নেতৃবৃন্দ, বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে বাস্তবতা এবং স্বাস্থ্যবিভাগ ও অন্যান্য সিভিল প্রশাসনের কর্মকা-ের মধ্যে স্পষ্টতই সমন্বয়হীনতা ও অবহেলা দেখতে পাচ্ছি। আমরা জানি বৈশি^ক এই মহামারির সময়ে দেশের সকল মানুষের মঙ্গলচিন্তার সঙ্গে অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকে স্থিতিশীল রাখতে আপনি নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নির্ঘুম কাজ করছেন। সেই মঙ্গলচিন্তা থেকেই আপনাকে সিলেটের বাস্তবতা জানানো জরুরি মনে করছি।এতে বলা হয়, সিলেট জেলায় করোনা আক্রান্তের সংখ্যা দুহাজারে পৌঁছেছে। প্রতিদিনই গড়ে অর্ধশতাধিক লোক আক্রান্ত হচ্ছে। কিন্তু, সেটা নমুনা পরীক্ষার সংখ্যার হিসেবে, বাস্তবে আক্রান্ত হয়ত আরো অনেক বেশি। কারণ অনেকে পরীক্ষার সুযোগই পাচ্ছে না। উপযুক্ত পদক্ষেপের অভাবে আক্রান্তরা বেপরোয়া ঘোরাফেরা করে সংক্রমণকে সর্বত্র ছড়িয়ে দিচ্ছে। বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হতে না পেরে, অক্সিজেন না পেয়ে অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে।
এ নিয়ে সিলেট-১ আসনের সংসদ সদস্য ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন তীব্র ক্ষোভ জানানোর পর এখন কিছু হাসপাতাল চিকিৎসা দিতে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু, সিলেট জেলায় যে ভয়াবহ করোনা পরিস্থিতি সরাসরি আপনি নির্দেশনা না দিলে কোনো পরিবর্তনের সুযোগ আমরা দেখছি না।স্মারকলিপিতে বলা হয়, করোনায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সিলেটের জননন্দিত নেতা, সাবেক মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরানকে হারিয়ে আমরা গভীর শোকাহত। এমন করুণ বিদায় রোধে অন্তত তিনটি বিষয়ে আপনার কাছে কঠোর ও কার্যকর নির্দেশনা প্রত্যাশা করছি। সিলেট নগরীসহ সিলেট জেলায় গত মে মাস পর্যন্ত আক্রান্ত ছিলেন ৫৫৫ জন। আর চলতি জুন মাসের প্রথম ২০ দিনেই নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় দেড় হাজার ব্যক্তি। মে মাস পর্যন্ত জেলায় মৃতের সংখ্যা ছিল ১৪। আর গত ২০ দিনে মারা গেছেন ৩১ জন। সাধারণ মানুষের সঙ্গে চিকিৎসক, নার্স, পুলিশ,র্যাব, সাংবাদিক, সাধারণ কর্মজীবী সবার মধ্যেই সংক্রমণ বাড়ছে। গ্রামেও ছড়িয়ে গেছে করোনাভাইরাস। কিন্তু, আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে সংক্রমণ রোধে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকলেও লকডাউন বা লোকজনের বেপরোয়া ঘোরাফেরা বন্ধ করতে কোনো উদ্যোগ নেই। সিলেট নগরীর প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ড ও জেলা পর্যায়ে সকল উপজেলার কোনো না কোনো এলাকা রেড জোনে পড়লেও প্রশাসন আশ্চর্যজনকভাবে নির্বিকার। এ ব্যাপারে এখনই কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা না গেলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিবে।স্মারকলিপিতে আরও উল্লেখ করা হয়, সিলেটে এক সপ্তাহ ধর্ণা দিয়েও করোনা পরীক্ষা করাতে পারছে না উপসর্গে ভোগা মানুষ। যারা নমুনা জমা দিচ্ছেন তাদের ফলাফল পেতে সময় লাগছে ১৫ দিন পর্যন্ত। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের একটি মাত্র ল্যাবে প্রতিদিন সর্বোচ্চ ১৮৮টি নমুনা পরীক্ষা হয়। এছাড়া শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ল্যাব থাকলেও সেখানে শুধু সুনামগঞ্জ জেলার নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। ফলে ব্যাপক নমুনা জট সৃষ্টি হয় এবং প্রায়ই ঢাকায় নমুনা পাঠাতে হয়। সেখান থেকে ফল পেতে দীর্ঘ সময় লাগে। এই সময়ে আক্রান্তরা স্বাভাবিক কর্মে থেকে অন্যদেরও আক্রান্ত করছে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়, সিলেটে করোনা শনাক্তে পর্যাপ্ত পিসিআর ল্যাব নেই। কিন্তু যে ল্যাব আছে আন্তরিক হলে তাতেও পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানো যেতে পারে। শাহজালাল বিশ^বিদ্যালয় কম সংখ্যক লোক নিয়ে যে পরিমাণ পরীক্ষা হচ্ছে সেখানে ওসমানী হাসপাতালে চারগুণ লোকবল নিয়ে সমান সংখ্যক পরীক্ষাই হচ্ছে। নমুনা বেশি হলে বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর দলটি কর্মঘণ্টা বাড়িয়ে পরীক্ষার সংখ্যা বাড়াচ্ছেন। কিন্তু ওসমানী হাসাপাতালে রুটিন ওয়ার্কের বাইরে কিছুই হচ্ছে না।সংক্রমণ রোধে পরীক্ষা সবচেয়ে আবশ্যিক, সেই বিবেচনায় সিলেটে পিসিআর ল্যাব বাড়ানো এবং বেশি সংখ্যক নমুনা পরীক্ষা নিশ্চিতে আপনার জরুরি নির্দেশনা প্রত্যাশা করছি।বাস্তবতার বিচারে সিলেটেও করোনা চিকিৎসা এবং আইসোলেশন সুবিধা একেবারেই অপ্রতুল। একমাত্র শহীদ ডা. শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে আমাদের। সেখানেও পর্যাপ্ত ভেন্টিলেশন সুবিধা এখনো নেই। সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী কয়েকটি ভেন্টিলেটরের ব্যবস্থা করলেও এখানে আরও ভেন্টিলেশন সুবিধা নিশ্চিত করা দরকার। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, সেখানে দায়িত্বরতদেরও আলাদা আবাসনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। ফলে তারা সেবা শেষে বাড়িতে যাচ্ছেন এবং পরিবারের সদস্যদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে বাধ্য হচ্ছেন। অথচ খুব সহজেই সরকারি ডাকবাংলো বা বেসরকারি হোটেল-রেস্ট হাউজকে এজন্য ব্যবহার করতে পারে প্রশাসন।বেশকটি দুঃখজনক ঘটনার পর পররাষ্ট্রমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে সিলেটে দুটি বেসরকারি হাসপাতাল করোনা আক্রান্তদের সীমিত আকারে সেবা দেওয়া শুরু করলেও তাতে যা খরচ আসছে-তা সাধারণ মানুষের পক্ষে বহন করা সম্ভব হচ্ছে না।স্মারকলিপিতে তারা প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, আমরা জানি সিলেটকে আপনি বিশেষ মমতা দিয়ে বিবেচনা করেন। এই চরম দুঃসময়ে আপনার সেই মমতার পরশটুকু চাই আমরা। কারণ বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের বদ্ধমূল ধারণা যে, সিলেটের প্রকৃত বাস্তবতা আপনার কাছে আড়াল করা হচ্ছে। কিন্তু সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণে আপনার কর্মদক্ষতার প্রতি আমাদের সর্বোচ্চ ভরসা রয়েছে। সিলেটকে মহামারির হটস্পট হওয়ার হাত থেকে রক্ষা ও আক্রান্তদের চিকিৎসায় পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে আমরা আপনার নির্দেশনার অপেক্ষা করছি ।সিলেটের সর্বস্তরের নাগরিকের পক্ষে স্মারকলিপিতে স্বাক্ষর করেন, সিলেট স্টেশন ক্লাবের প্রেসিডেন্ট মুক্তিযোদ্ধা সদর উদ্দিন আহমদ চৌধুরী, মুক্তিযোদ্ধা নিজাম উদ্দিন লস্কর, গণতন্ত্রীপার্টির সভাপতি মো. আরশ আলী, এডভোকেট বেদানন্দ ভট্টাচার্য, সিলেট জেলা জাসদের সভাপতি লোকমান আহমদ, সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এমাদ উল্লাহ শহিদুল ইসলাম, সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিন আহমদ, সিলেট প্রেসক্লাবের সভাপতি ইকবাল সিদ্দিকী, সনাক সিলেটের সভাপতি আজিজ আহমদ সেলিম, সিলেট প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি আহমেদ নূর, সিলেট জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার সুব্রত চক্রবর্তী জুয়েল, সুজন সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী, সিলেট চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবু তাহের মো. শোয়েব, সিলেট মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আফজাল রশিদ চৌধুরী, সিলেট মহানগর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ইউনিট কমান্ডার ভবতোষ রায় বর্মণ, সিলেট প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ইকরামুল কবির, সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ফজলুল হক সেলিম এডভোকেট, সম্মিলিত নাট্য পরিষদ সিলেটের সভাপতি মিশফাক আহমদ মিশু, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি আমিনুল ইসলাম চৌধুরী লিটন, বাংলাদেশ প্রতিদিনের সিলেট ব্যুরো প্রধান শাহ্ দিদার আলম নবেল, সিলেট জেলা কর আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এডভোকেট মৃত্যুঞ্জয় ধর ভোলা, বাকবিশিস কেন্দ্রীয় কমিটি প্রেসিডিয়াম সদস্য ভাস্কর রঞ্জন দাশ, সিলেট জেলা ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি মো. সিকন্দর আলী, বাপার সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম কিম, ইমজা সিলেট এর সাধারণ সম্পাদক সজল ছত্রী, ভূমিসন্তান বাংলাদেশের আশরাফুল কবীর ও জাতীয় শিশু কিশোর সংগঠন খেলাঘর সহ সভাপতি অরূপ শ্যাম বাপ্পী।