গল্প
একদা গ্রামে একটি সাধারণ পরিবার বাস করত। পরিবারে ছিল মা-বাবা দুই ভাই-দুই বোন। পুরো গ্রামে সেই পরিবারটি ছিল অত্যন্ত শান্ত সুখী ও নির্ভেজাল। মা-বাবা বার্ধক্য ও অসুস্থ হওয়ায় পরিবারের সকল দায় দায়িত্ব পালন করত বড় সন্তান বড় ছেলে। ছোট ভাই বোনদের পড়ালেখার খরচ পরিবারের খরচ, মা বাবার জন্য ওষুধ পার্টি সবকিছুই দেখ বাল করতে হতো পরিবারের বড় ছেলেকে। তবু কঠোর পরিশ্রম করে বড় ছেলে পরিবারের কাউকে কিছু বুঝতে দেয়নি অভাব কি জিনিস। এমনকি একদিনের জন্য ছোট ভাইকে বুঝতে দেইনি অভাব কি। শুধু ছোট ভাইকে বলতো পড়াশোনা ভালো করে করিস, তোমাকে মানুষের মতো মানুষ হতে হবে, একদিন ভালো চাকরি করতে হবে মা বাবার মুখ উজ্জ্বল করতে হবে আমার মান রাখতে হবে সবাই বলবে তুমি আমার ভাই ভালো মানুষ বড় অফিসার। আর তার জন্য যা যা করা দরকার আমি সবি করব বড় ভাইয়ের কথা ছিল এমন। বড় ভাইয়ের অনুপ্রেরণায় ছোট ভাইও ভালো করে পড়াশোনা করতে লাগল প্রতিটি পরীক্ষা খুব কৃতিত্বের সাথে ভালো ফল করতে লাগলো এভাবেই চলছে দিন। কিন্তু এর মধ্যে অনেক সময় অতিক্রম করল এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে ছোট ভাই। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পড়তে একটি বড় ঘরের মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব হল ছোট ভাইয়ের। মেয়েটিও একই বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনা করে। বন্ধুত্ব থেকে ভালোলাগা ভালোবাসা এক পর্যায়ে মেয়েটির সাথে ছোট ভাইয়ের সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ হলো। পড়াশোনার শেষ প্রান্তে এক পর্যায়ে বড় ভাইকে ছোট ভাই ঐ মেয়েটিকে বিয়ে করার কথা বলল এবং বড় ভাই থেকে অনুমতি চাইল। বড় ভাইয়ের ইচ্ছা হল ছোটভাইয়ের খুশিতেই তার খুশি তাই ছোট ভাইয়ের ইচ্ছাকে গুরুত্ব দিলো পরে খরচ পাটী দিয়ে ছোট ভাইকে ঐ মেয়েটির সাথে বিয়ে দিল। এরপর চলছে সংসার সংসারে আরো খরচ বেড়ে গেল সংসারের সমস্ত ভার বহন বড় ভাইয়ের উপর চলতে লাগল ছোট ভাই এখনো চাকরী – বাকরি হয়নি সদ্য পড়াশোনা শেষ করেছে। ছোট ভাই বিভিন্ন জায়গায় চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছে দিচ্ছে একদিন বিশেষ একটা সরকারি পরীক্ষা দিল এবং পরীক্ষায় রেজাল্টও ভালো করলো এভাবে গেল কয়েক মাস। হঠাৎ একদিন অফিস থেকে মৌখিক পরীক্ষার জন্য ডাক পড়লো, মৌখিক পরীক্ষা মানে বড় ভাই বুঝলো আসল পরীক্ষা। তাই বড় ভাইটি ছোট ভাইয়ের মৌখিক পরীক্ষার জন্য নতুন জামা কাপড় বাজার থেকে এনে দিল যেহেতু মৌখিক পরীক্ষায় তার পোশাক-আশাক আচার-আচরণ কথাবার্তা ইত্যাদি যাচাই-বাছাই করবে এজন্য ছোট ভাইকে পরামর্শ দিল ফিটফাট করে যাওয়ার জন্য। বড় ভাই মহাখুশি, ছোট ভাইয়ের এ সাফল্যের জন্য তিনি অপেক্ষা করছেন। তার এতদিনের পরিশ্রম কষ্ট যেন তার কাছে কিছুই না। কয়েক মাস পর খবর এলো ঐ অফিসের পরিচিত এক কর্মকর্তা মারফত ছোট ভাইকে চাকরি পেতে হলে ৪ লাখ টাকা দিতে হবে। ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে খবরটা শুনে বড় ভাইয়ের মাথার উপর আকাশটা যেন ভেঙে পড়েছে, এমন খবরে এত টাকা কেমন করে দেব কোথা থেকে দেব কি করে দেব ইত্যাদি প্রশ্নের বড় ভাই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। টেনশনে টেনশনে তার আর ঘরে মন বসলো না খাওয়া-ঘুম হল না বাইরে বাইরে ঘুরতে লাগলো বাজার রাস্তাঘাট চা দোকানে ইত্যাদি জায়গায় বসে বসে চিন্তা করতে লাগলো। হঠাৎ একদিন চা দোকানের পাশে এক ভদ্রলোক পেপার পড়ছে বড় বড় শব্দ করে ভদ্রলোকটি পেপারে নাকি একটি বিজ্ঞপ্তি আছে কেউ যদি চোখ দান করে তবে তাকে তার প্রয়োজন মতো অর্থ দেওয়া হবে এমন খবর শুনে বড় ভাই ভদ্রলোকটির পাশে গিয়ে বসল তার সাথে কথা বলল। তিনি ভদ্রলোকটিকে নিজেকে আর বেশি দিন বাঁচবেন না বলে আমার রোগ আছে বলে সেই চক্ষু গ্রহণকারী লোকের কাছে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করে আকুতি মিনতি করল। পরে ভদ্রলোকটি তার কথা অবস্থা শুনে বুঝে তাকে সেই বিজ্ঞপ্তি ঠিকানা বরাবর নিয়ে গেল এবং বিজ্ঞাপন দানকারী সাথে কথা বলিয়ে দিল। বড় ভাইটি তার সমস্যার কথা বলল তার অসুখের কথা বলল তার প্রয়োজনের কথা বলল তাতে বিজ্ঞাপন দানকারীও তার প্রস্তাবে রাজি হল। তারপর তার ডান চোখ সে বিক্রি করে যথা সময়ে টাকা নিয়ে ঐ অফিসের কর্মকর্তার হাতে ঢাকা পৌঁছে দিল। এরপর বাড়িতে এসে সবাইকে বলল তার চোখে একটা বড় সমস্যা হয়েছে ডাক্তার বলেছে সব সময় কালো চশমা দিয়ে রাখতে কখনো খোলা যাবে না খুললে ঘুমের সময় শুধুমাত্র খুলতে পারবে এমন বলে পরিবারের লোকজনকে সামলে নিল। কিন্তু মা বলে কথা সন্তানের সব খবরা খবর না রেখে কি হয় একদিন তার লুকোচুরি ধরা খেলো মায়ের কাছে তারপর তার মাকে তার বিছানার পাশে ডেকে চুপে চুপে সব কথা খুলে বলল, তার ছোট ভাইয়ের চাকরির জন্য টাকা দরকারের কথা টাকার বিনিময়ে চক্ষুদান করার কথা এবং মাকে সাথে সাথে কসম করে নিল যাতে কাউকে কিছু না বলতে। মাও ছেলের কথায় চোখের জল মুছে মেনে নিল। এভাবেই সংসারের হাল ধরতে লাগলো এক চোখ দিয়ে সে তার দৈনন্দিন কাজ স্বাভাবিকভাবে কষ্ট করে করে যেতেই লাগল। মাস খানেক পর তার ছোট ভাইয়ের চাকরির খবর এসে গেল এপারমেন লেটার যোগদান করতে হবে পাশের থানা অফিসে। ছোট ভাইও চাকরি পেয়ে খুশি যোগদান করলো আপন কর্মস্থলে এভাবেই যাচ্ছে দিনকাল। ছোট ভাইয়ের বউ একটু বড় ঘরের মেয়ে হওয়ায় সবাই তার কথায় পরিবারে লোকজন চলত বসতো তার খেয়াল খুশিমতো থাকত। এতদিনে ছোটখাটো পরিবারের ঝামেলাগুলো মা এবং বড় ভাই ধৈর্যসহকারে সহ্য করত এভাবে পার পেয়ে যেত। এভাবেই যেতে যেতে একদিন ছোট ভাই ছুটি নিয়ে বাড়িতে আসলো কয়েক দিনের জন্য। কিন্তু কি দুর্ভাগ্য ভাই বাড়িতে পৌঁছতে না পৌঁছতেই সাথে সাথে বউ জামাইয়ের কাছে তার ভাসুর অর্থাৎ বড় ছেলে বড় ভাইয়ের নামে নানা অভিযোগ ভিত্তিহীন কথা বানিয়ে বানিয়ে জামাইয়ের কাছে বললো। তোমার বড়দা আমাকে চোখ মারে নানা ভাবে তাকায় এমন এমন অভিযোগ তুলে জামাইয়ের কাছে বড় ভাইয়ের নামে রাগ দেখিয়ে বানিয়ে বানিয়ে নালিশ করল। তখন ছোট ভাইও বউয়ের কথা শুনে বড় ভাইয়ের উপর রেগে মায়ের কাছে নালিশ করল। এখন দুই ছেলের অবস্থান দুই রকম মা কোন দিকে যাবে এই ভেবে কুল না পেয়ে মা গ্রামে একটি সালিশের আয়োজন করল। গ্রামের কয়েকজন মুরুব্বী সহ গণ্যমান্য এলাকাবাসী নিয়ে সালিশ শুরু হলো তখন মা দুই ছেলে ও বৌমাকে দাঁড় করালো সালিশের উঠানে। মা বৌমাকে প্রশ্ন করল বৌমা আমার বড় ছেলে তোমাকে কোন চোখ দিয়ে তাকায় কোন চোখ দিয়ে চোখ মারে সবার সামনে বল, আমি তার চোখ উপড়ে ফেলবো, বড় ছেলেটি তখনও কালো চশমা দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সালিশে। ছোট ভাইয়ের বউটি বলল ডান চোখ দিয়ে, তখন মা ঠিক আছে বলে ডান চোখ দিয়ে বলে রেগে ছেলেটির চোখের সামনে থেকে চশমাটা খুলে নিল। দেখি বড় ছেলে ডান চোখ নেই তবে সবাই দেখলো তার ডান চোখ একটা নেই সবাই এই অবস্থা দেখে অবাক। এখন প্রশ্ন উঠলো কি করে হলো এই অবস্থা সেই এচোখ দিয়ে ছোট ভাইয়ের বউকে কেমন করে চোখ মারলো কেমন করে তাকাল ইত্যাদি। তখন তার মা বড় সন্তান তার সূর্যসন্তানের সেই করুন কাহিনী সবার সামনে বলতে শুরু করল, ছোট ছেলেকে বলল তোর লেখা পড়ার জন্য আমাদের পরিবারের জন্য দিনের পর দিন রাতের পর রাত আমার এই ছেলে কষ্ট করে গেছে মুখ বুঝে কাউকে কোনো কষ্ট দুঃখ বুঝতে দেয়নি। কি না করেছে সে আমাদের জন্য তোমার চাকরির টাকা যোগার করার জন্য সে নিজের চোখকেও বিক্রি করে দিয়েছে আর সেই লক্ষী দেবতার মত ভাই কে তুমি বউয়ের কথা শুনে না বুঝে না জেনে সন্দেহ করে আঘাত করলে, এই তোর শিক্ষা এই তোর মানবতা বলে ধিক্কার দিল। পরে বৌমাও নিজের দোষ স্বীকার করলো বলল সে নিজের জামাইকে আলাদা করার জন্য আলাদা ঘরে থাকার জন্য এসব কিছু বানিয়ে বানিয়ে বলছে। শেষে সব কিছু দেখার পর বুঝার পর আর কিছু করার বলার থাকেনা। এভাবেই সমাজে বড় পরিবার থেকে বিভেদ সৃষ্টি হয় ছোট পরিবারের জন্ম হয় সুখী পরিবার থেকে বিবাদ সৃষ্টি হয়ে একঘেয়েমি পরিবার তৈরি হয়। তাই কোন কিছু করার আগে বলার আগে নিজেকে বুঝুন পরিবারকে বুঝুন শুধু বউয়ের কথায় প্রতিবেশীদের কথায় নিন্দুক লোকের কথায় কান না দিয়ে আর কেউ যেন এমন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এ দিকে বিশেষ নজর রাখার আহ্বান। সকল নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই একটি সমসাময়িক ঘটনা তুলে ধরছি — সবার পরিবার হোক সুখের ।