শনিবার-৭ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৩শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-৪ঠা রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

বৌদ্ধ ধর্মে আষাঢ়ী পূর্নীমার তাৎপর্য্য ।

লায়ন সুপায়ন বড়ুয়া
“রাজকুমার সিদ্ধার্থের মানবকূলে জন্ম নেওয়ার জন্য রাণী মহামায়া’র গর্ভে প্রতিসন্ধি গ্রহণ, সিদ্ধার্থের গৃহত্যাগ, গৌতম বুদ্ধ কর্তৃক ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্র দেশনা বা বৌদ্ধ ধর্মমত প্রচার, প্রাতিহার্য ঋদ্ধি তথা আধ্যাত্মিক শক্তি প্রদর্শন এবং গৌতম বুদ্ধের পরলোকগত মাতৃদেবী (রাণী মহামায়া) কে অভিধর্ম দেশনা প্রদান”
মহামানব গৌতম বুদ্ধের জন্মপূর্ব এবং জন্মোত্তর এইসব ঐতিহাসিক ঘটনার সমন্বয় “আষাঢ়ী পূর্ণিমা” বৌদ্ধদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব।এটি বৌদ্ধদের পরম কল্যাণময় ও পূণ্যময় তিথি।
🔘১।সিদ্ধার্থের মাতৃগর্ভে প্রতিসন্ধি গ্রহণ
“আষাঢ়ী পূর্ণিমায় গৌতম বুদ্ধ সিদ্ধার্থরূপে মাতৃগর্ভে প্রবিষ্ট হয়েছিলেন। বর্ণিত আছে কপিলাবস্তু নগরে আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা সাড়ম্বরে উদযাপিত হতো। এক আষাঢ়ী পূর্ণিমায় রাজা শুদ্ধোধনের মহিষী রানি মায়াদেবী আষাঢ়ী পূর্ণিমার উৎসব শেষ করে ঘুমিয়ে পড়লেন । আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ ছিল। চাঁদের আলোয় চারিদিক উদ্ভাসিত। সে রাত্রে রাণী এক অপূর্ব স্বপ্ন দেখলেন। স্বপ্নমগ্না হয়ে রানি দেখলেন যে চারদিক থেকে চার দিকপাল দেবতা এসে রানিকে সোনার পালঙ্কে তুলে নিলেন তারপর তাঁকে নিয়ে গেলেন হিমালয় পর্বতের মানসসরোবরে। ওখানে দেবতাদের মহিষীরা মায়াদেবীকে স্নান করিয়ে সুবাসিত দিব্যবস্ত্রে ভূষিত করলেন। রানি আরও দেখলেন তিনি সোনার পালঙ্কে শুয়ে আছেন। পাশের স্বর্ণপর্বত থেকে এক শ্বেতহস্তী নেমে এল, শুঁড়ে ছিল একটি শ্বেতপদ্ম। শ্বেতহস্তীটি রানির পালঙ্কের চারপাশে তিনবার প্রদক্ষিণ করল। এরপর রানির জঠরের দক্ষিণ দিকে শ্বেতপদ্মটি প্রবেশ করিয়ে দিলেন। অলৌকিক আনন্দে শিহরিত হলেন রানি। পর দিন ঘুম থেকে জেগে রাণী মহামায়া রাজা শুদ্ধোধনকে স্বপ্ন বৃত্তান্ত অবহিত করলেন। কালবিলম্ব না-করে রাজা শুদ্ধোধন সকল রাজ-জ্যোতিষীকে ডেকে স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে চাইলেন। তাঁরা বললেন, মহারাজ, সুসংবাদ আছে, আনন্দ করুন, আপনার মহিষী সন্তানসম্ভবা। তিনি এমন এক পুত্ররত্ন লাভ করবেন যার ফলে বসুন্ধরা ধন্য হবে।”
🔘২। রাজকুমার সিদ্ধার্থের গৃহত্যাগ
“সিদ্ধার্থের বয়স ২৯বছর। একদিন রাজকুমার ভ্রমণে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। মহারাজ শুদ্ধোদন পুত্রের ভ্রমণ যেন আনন্দময় হয় সে-ব্যবস্থা করলেন। সারথি ছন্দককে নিয়ে রাজকুমার নগরভ্রমণে বের হলেন। সঙ্গে প্রিয় অশ্ব কন্থক। নগরভ্রমণে বের হয়ে তিনি প্রথম দিন দেখলেন একজন বৃদ্ধ, দুর্বল ও পক্বকেশ, লাঠিহাতে শীর্ণ শরীরে বহু কষ্টে হেঁটে চলেছেন। দ্বিতীয় দিন দেখলেন এক ব্যক্তি গাছের তলায় হাহাকার করছে, বেদনায় তার মুখ-চোখ কুঁকড়ে গেছে। তৃতীয় দিন দেখলেন কিছু লোক একটি শবদেহ কাঁধে নিয়ে বিলাপ করতে করতে যাচ্ছে। চতুর্থ দিন দেখলেন নগরের বাইরে বেশ কিছু দূরে নির্জন জায়গায় বড় গাছের তলায় একজন সন্ন্যাসী ধ্যানমগ্ন। এই চার নিমিত্ত দর্শনের পরে সিদ্ধার্থ গৌতমের মনে শান্তি নেই। সব সময়ই তিনি গভীর চিন্তায় মগ্ন থাকতেন। ঐ তরুণ সন্ন্যাসীর গভীর ধ্যানমগ্ন দৃশ্যটি গৌতমের মনে দাগ কেটেছে। তিনি দুঃখমুক্তির সন্ধানে গৃহত্যাগ করবেন সিদ্ধান্ত নিলেন। এর মধ্যে গোপাদেবীর কোল আলো করে একটি পুত্র সন্তান জন্ম নিল। পুত্র রাহুলের জন্মের খবর পেয়ে গৌতম নিজের অজান্তে বলে উঠলেন, ‘রাহু জন্মেছে, বন্ধন উৎপন্ন হয়েছে।’ মায়ার বন্ধন বৃদ্ধির ভয়ে আনন্দ লাভের পরিবর্তে গৃহত্যাগের বাসনা তীব্র হয়ে উঠল। আর দেরি না করে আরেক আষাঢ়ী পূর্ণিমার গভীর রাতে তিনি গৃহত্যাগ করেন।”
🔘৩। ধর্মচক্র প্রবর্তন
“ছয় বছর কঠোর সাধনার পর পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে তিনি বুদ্ধগয়ায় “বুদ্ধত্ব” লাভ করেন। বুদ্ধত্ব লাভের পর তিনি তাঁর নবলব্ধ ধর্ম প্রচারে ব্রতী হন। এজন্যে তিনি এক আষাঢ়ী পূর্ণিমায় সারনাথের ঋষি পতন মৃগদাবে উপস্থিত হলেন। ঐইখানে তখন অবস্থান করছিলেন তাঁর পূর্বের পাঁচ সঙ্গী : কৌন্ডিন্য, বপ্প, ভদ্দিয়, মহানাম ও অশ্বজিৎ। এঁদের কাছেই তিনি প্রথম নবলব্ধ ধর্মপ্রচার করলেন। এঁরাই বুদ্ধের কাছে প্রথম দীক্ষাপ্রাপ্ত ভিক্ষু। বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে এঁরা পঞ্চবর্গীয় শিষ্য নামে পরিচিত। তাঁদের দীক্ষার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা লাভ করলো ‘ভিক্ষুসংঘ’। বুদ্ধের প্রথম ধর্ম-দেশনা ‘ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্র’ নামে খ্যাত। বুদ্ধ দেশনা করলেন, নব আবিষ্কৃত চতুরার্য সত্য, আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ, প্রতীত্যসমুৎপাস তত্ত্ব, অনিত্য ও অনাত্মবাদ।”
🔘৪। যমক প্রাতিহার্য প্রদর্শন
“ঋদ্ধিলাভী ভিক্ষুদের ঋদ্ধি প্রদর্শন বুদ্ধকর্তৃক নিষিদ্ধ করার পরেও বিপথগামীদের সত্যপথে আনয়নের উদ্দেশ্যে মগধরাজ বিম্বিসারের বিনম্র অনুরোধে বুদ্ধ স্বয়ং পবিত্র আষাঢ়ী পূর্ণিমা দিবসে শ্রাবস্তীর জনসমক্ষে যমক প্রাতিহার্য অর্থাৎ দুই বিপরীত মুখী ঋদ্ধি প্রদর্শন করেন। তথাকার রাজোদ্যানের মালী গন্ড বুদ্ধকে একটি পাকা আম দান করলে তিনি গন্ডকে তা মাটিতে পুতে রাখার আদেশ দেন। বুদ্ধ এর উপড় হাত ধুয়ে জল দেয়া মাত্র তা প্রায় পঞ্চাশ হাত উঁচু বিশাল এক আম্র বৃক্ষে পরিণত হয়। এরপর বুদ্ধ এ স্হানে অলৌকিক ক্ষমতাবলে শুণ্যের উপড় একটি মণিময় বিহার ভূমি সৃষ্টি করে তাতে আরোহণ পূর্বক যমক প্রাতিহার্য প্রদর্শন করেন।”
🔘৫। অভিধর্ম দেশনা
“মহাকারুণিক বুদ্ধ মাত্র এক সপ্তাহ মায়ের দুধ পান করেছিলেন। মাতৃসেবা এবং মাকে ধর্ম জ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি বলে বুদ্ধ তাবতিংস স্বর্গে যান। মাকে ধর্ম উপদেশ দেবার জন্য সেখানে তিন মাস বর্ষাবাস যাপন করে মাকে অভিধর্ম দেশনার মাধ্যমে স্রোতাপত্তি মার্গফলে প্রতিষ্ঠিত করে মাতৃ ঋণ শোধ ও কর্তব্য পালন করে জগতে এক অবিস্মরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। যা আমাদের সকলের জন্য অনুকরণীয়।”
এ পূর্ণিমা তিথিতেই তথাগত গৌতম বুদ্ধ ভিক্ষুদের জন্য বর্ষাব্রতের নিয়মও প্রবর্তন করেন।এ পূর্ণিমাতেই বৌদ্ধ ভিক্ষুরা ত্রৈমাসিক বর্ষাব্রত বা ওয়া অধিষ্ঠান গ্রহণ করেন।তথাগত সম্যক সম্বুদ্ধ কর্তৃক বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জন্য বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান বা ওয়ার নিয়ম প্রবর্তন আষাঢ়ী পূর্ণিমার একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। ধর্ম প্রচারের প্রথমাবস্থায় বৌদ্ধ ভিক্ষুরা সারাবছরই নিয়োজিত থাকতেন। তখন বর্ষাব্রতের কোন বিধান ছিল না। কিন্তু বর্ষাকালে ভিক্ষুরা বিভিন্ন রকম অসুবিধা ভোগ করত। তাঁরা কর্দমাক্ত পথে যাতায়াতের সময় প্রচুর কষ্ট ভোগ করতেন। পোকা-মাকড় এবং সাপের দংশনে অনেকের প্রাণ সংহার হতো। ঝড়-বৃষ্টিতে ভেজার কারণে নানারকম রোগ হতো। ভেজা কাপড় পরে থাকতে হতো। কারণ তখনো দায়ক-দায়িকাদের নিকট থেকে চীবর গ্রহণের নিয়ম প্রচলন হয়নি। ফলে ভিক্ষুসংঘ নানারকম জটিল রোগে আক্রান্ত হতেন। তা ছাড়া বর্ষাকালে ভিক্ষুদের যাতায়াতে অনিচ্ছাকৃতভাবে অনেক সবুজ তৃণ এবং ক্ষুদ্র প্রাণী ভিক্ষুদের পদদলিত হতো। বুদ্ধ রাজগৃহের বেণুবন বিহারে অবস্থানকালে এসব বিষয়ে জ্ঞাত হন। তখন তিনি বর্ষা ঋতুর তিন মাস অর্থাৎ আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা তিথি থেকে আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা তিথি পর্যন্ত বিহারে বসবাস করে ধর্মালোচনা, ধর্ম শ্রবণ, ধ্যান-সমাধি এবং বিদ্যাচর্চা করে অতিবাহিত করার জন্য ভিক্ষুদের নির্দেশ দেন। তখন থেকে বর্ষাবাস উদযাপন শুরু হয়। বর্ষাকালে বিহারে বসে এই ব্রত বা অধিষ্ঠান পালন করা হয় বলে এটিকে বর্ষাবাসব্রত বলে। বর্ষাবাসব্রতকালে ভিক্ষুসংঘ কায়িক, বাচনিক এবং মানসিক পরিশুদ্ধিতা অর্জন করে। বর্ষাবাসব্রত পালনের মাধ্যমে ভিক্ষুদের জ্যেষ্ঠতাও নির্ধারণ করা হয়। তাই বর্ষাবাসব্রতকে আত্মশুদ্ধির অধিষ্ঠান বলা হয়। অধিকন্তু ভিক্ষুর বর্ষাবাসব্রত পালনের মধ্য দিয়ে ‘প্রবারণা’ উদযাপনের সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং প্রবারণার ধারাবাহিকতায় ‘কঠিন চীবর দান’ সম্পাদনের সুযোগ লাভ করা যায়।
আষাঢ়ী পূর্ণিমা ও বর্ষাবাসের কার্যক্রমের সঙ্গে উপোসথ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। উপোসথ ভিক্ষু এবং গৃহী উভয়ের পালনীয় একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান।বৌদ্ধ ধর্মে উপোসথের গুরুত্ব খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ভিক্ষু সংঘের পাশাপাশি বর্ষাবাসব্রত বা ওয়ার ৩ মাস সময় গৃহীরাও অষ্টমী, অমাবস্যা, পূর্ণিমা তিথিতে উপোসথ পালন তথা প্রাণীহত্যা, চুরি বা অদত্তবস্তু গ্রহণ, অব্রহ্মচর্য আচরণ, মিথ্যা ভাষণ, নেশাদ্রব্য গ্রহণ, বিকাল ভোজন, নৃত্য-গীত-বাদ্যে প্রমত্ততা দর্শন এবং অলঙ্কার ও সুগন্ধ দ্রব্য ব্যবহার, উচ্চ শয্যা ও মহাশয্যায় শয়ন কিংবা উপবেশন এই আট প্রকার কাজ থেকে বিরত থেকে দান, শীল, ভাবনার মাধ্যমে অতিবাহিত করে। উপোসথ পালনে ধর্মানুভূতি জাগ্রত হয়। কায়-মন-বাক্য এবং পঞ্চ ইন্দ্রিয় সংযত হয়। ধর্মময় উৎকৃষ্ট জীবন গঠনের জন্য বুদ্ধ উপোসথের প্রবর্তন করেছিলেন।
এরই আলোকে বৌদ্ধরা আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে আশ্বিনী বা প্রবারণা পূর্ণিমা পর্যন্ত তিনমাস বর্ষাবাস অধিষ্ঠানের পর আকাশ প্রদীপ বা ফানুস উত্তোলনের মধ্য দিয়ে জগতের সকল প্রাণীর সুখ-শান্তি কামনা করেন।
Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on telegram
Telegram
Share on skype
Skype