
চট্টগ্রামের উন্নয়ন এবং এ জনপদে আলোকিত মানুষ সৃষ্টিতে দৈনিক আজাদী প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক অতুলনীয় দূরদর্শিতা দেখিয়েছিলেন। আর তাঁর দেখানো পথ ধরে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ করেছেন আজাদীকে। এ দুই মহান ব্যক্তিত্ব তাদের জীবৎকালে দেখিয়ে গেছেন মানবমুক্তি এবং সমাজমুক্তির লক্ষ্যে কাজ করাই সাংবাদিকদের প্রকৃষ্ট পথ। সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতিতে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ ছিলেন চট্টগ্রামের অভিভাবক। অবহেলিত চট্টগ্রামের উন্নয়ন এবং এ জনপদে ।
বুধবার বিকেলে চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য, স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, দৈনিক আজাদীর সাবেক সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে চট্টগ্রাম একাডেমি আয়োজিত অধ্যাপক খালেদের কর্মকৃতি আলোচনায় একুশে পদকপ্রাপ্ত চট্টগ্রাম তথা দেশের পাঁচ গুণী ব্যক্তিত্ব এ অভিমত ব্যক্ত করেন।
প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রফেসর ড. অনুপম সেনের সভাপতিত্বে এবং বিশিষ্ট আবৃত্তিশিল্পী আয়েশা হক শিমুর সঞ্চালনায় স্মরণানুষ্ঠানে একুশে পদকপ্রাপ্ত অন্য চার আলোচক হলেন, সংবাদ ব্যক্তিত্ব ও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক, ভাষাবিজ্ঞানী ড. মাহবুবুল হক, কবি ও সাংবাদিক অধ্যাপক আবুল মোমেন ও শিক্ষাবিদ ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া।
পরিবারের পক্ষ থেকে বক্তব্য দেন, অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের পুত্র সাপ্তাহিক স্লোগান সম্পাদক মোহাম্মদ জহির। প্রফেসর ড. অনুপম সেন বলেন, অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ চট্টগ্রামের অভিভাবকে পরিণত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন আলোকবর্তিকা, যার জন্মই হয়েছে এ সমাজকে, সমাজের মানুষগুলোকে আলোকিত করার জন্য। আজাদী ও অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ সম্বন্ধে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, সত্তরের নির্বাচনের সময় প্রথম আজাদী সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ সম্পর্কে জানতে পারি।
, আজাদীর ক্ষেত্রে একটা ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছে। তা হলো আজাদীই একমাত্র পত্রিকা, যে পত্রিকার দু’জন সম্পাদক রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ দুটি পদকে ভূষিত হয়েছেন। একুশে পদক পাওয়ার পর আমি অনেক অনুষ্ঠানেই বলেছি, সৎভাবে কোনো পুরষ্কারের প্রত্যাশা ছাড়াই যদি কাজ করে যাওয়া যায়, তবে তার সুফল অনিবার্য। একুশে পদক প্রাপ্ত আমরা আজ পাঁচজন এখানে আছি। আমরা সৌভাগ্যবান, কেননা এই পদক আমাদের এমন একটি সম্মান পাইয়ে দিয়েছে যা মানুষ চাইলেও পায় না। সেটা হলো আমাদের মৃত্যুর পর প্রাণ প্রিয় লাল সবুজ পতাকায় ঢাকা থাকবে আমাদের কফিন।
এই সৌভাগ্য আমরা পেয়েছি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু মেখ মুজিবুর রহমানের জন্য। তাঁকে বলা হয় হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। কিন্তু আমি তাঁকে ব্র্যাকেট বন্দী করতে চাই না। তাই আমি বলি তিনি যুগ যুগান্তরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। ড. মাহবুবুল হক বলেন, অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ এমন একজন ব্যক্তিত্ব, যাঁকে আমরা নানাভাবে চিনি, জানি। ১৯৬৭ সালে চট্টগ্রাম কলেজে পড়ার সময় তাঁর সাথে আমার পরিচয়। আজাদী অফিস তখন ছিল কোহিনূর প্রেসের দোতলায়। প্রকাশনার কারণে প্রায় সময় সেখানে যাওয়া হতো। আজাদীতে আমার লেখার সূচনায় তাঁর বড় ভূমিকা ছিল। প্রথম লেখা শুরু করি আজাদীর আগামীদের আসর নামে ছোটদের পাতায়। পরে তাঁর প্রেরণায় আজাদীতে কলাম লিখতাম, ‘আক্কেল মিয়া’ ছদ্মনামে। লেখাগুলো এত কড়া চিল যে ৭/৮ কিস্তির পর বন্ধ হয়ে যায়। তাঁর প্রণোদনায় আজাদীতে বহু লেখক- সাংবাদিকতার শিক্ষা পেয়েছেন।
তিনি বলেন, একটা নাগরিক জীবনে অভিভাবক দরকার। অবিভাবক নাই বলেই আজকাল সমাজে এত অধ:পতন। এখন এলাকাভিত্তিক নেতা তৈরি হয়েছে, ভালো খারাপ সবকিছু তাকে ঘিরে। এই সমাজে খালেদ সাহেবের মতো মানুষের দরকার। তিনি আজাদী সম্পর্কে বলেন, দৈনিক আজাদী ৬২ বছর অতিক্রম করছে। বাংলাদেশে খুব কম পত্রিকা আছে, যেগুলো নিজস্ব চরিত্র বজায় রেখেছে। আজাদী সেই প্রথম থেকে এখন পর্যন্ত চট্টগ্রামের মানুষের কথা বলে এসেছে। মালেক সাহেবও সেই রীতিটা ধরে রেখেছেন। সাধারণ সহজ সরল অনাড়ম্বর জীবন যাপন করে মানুষের কাছে পৌঁছানো-এটা এখন কমে যাচ্ছে। যেটা ছিল খালেদ সাহেবের মধ্যে। আজ মানুষ মানুষের গুণ খোঁজার চেষ্টা করে না। অর্থ-প্রতিপত্তিকে গুরুত্ব দেয়। এ সমাজকে মেরামত করা, মানবিক করার মধ্য দিয়ে খালেদ সাহেবকে আমরা শ্রদ্ধা জানাতে পারি। শিক্ষাবিদ ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া বলেন, তিনি ছিলেন বহু গুণে গুণান্বিত এক ব্যক্তিত্ব।
তিনি অধ্যাপনা করেছেন, রাজনীতি করেছেন, সাংবাদিকতা করেছেন। গভীর অন্ত:দৃষ্টি সম্পন্ন মানুষ ছিলেন অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। তিনি তার দীর্ঘ কর্মময় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নৈতিকতা ও আদর্শের কারণে সফল হয়েছেন। তবে সবচেয়ে বড়ো কথা তিনি একজন ভালো মানুষ ছিলেন। নিজেকে একটি অনুকরণীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছিলেন। খালেদ সাহেব একজন পরিপূর্ণ মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ ছিলেন। ছিলেন আপাদমস্তক বাঙালি। তিনি ধর্মপরায়ণ মানুষ ছিলেন কিন্তু ধর্মান্ধ ছিলেন না। সেই ধন্য নর ক’লে, মানুষ যাকে নাহি ভুলে। অধ্যাপক খালেদ ছিলেন তেমন একজন ব্যক্তিত্ব। আমার শিক্ষক বিমলেন্দু বড়ুয়ার মাধ্যমে তাঁর সাথে পরিচয়, পরিচয় থেকে সখ্যভাব। উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা কবি-সাংবাদিক রাশেদ রউফসহ সাহিত্য অনুরাগী ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। এর আগে বিকেল সাড়ে ৪টায় চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠিত হয়।
প্রতিযোগিতায় প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকারীদের পুরস্কার ও সনদ প্রদান করা হয়। অন্য সবাইকে অংশগ্রহণ সনদ ও পুরস্কার হিসেবে বই প্রদান করা হয়। চট্টগ্রাম একাডেমির পরিচালক ড. আনোয়ারা আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন একাডেমির মহাপরিচালক আমিনুর রশীদ কাদেরী। বক্তব্য দেন, সাবেক মহাপরিচালক নেছার আহমদ, পরিচালক এসএম আবদুল আজিজ, অধ্যাপক কাঞ্চনা চক্রবর্তী, অধ্যাপক গোফরান উদ্দিন টিটু, পরিচালক দীপক বড়ুয়া, চারুকলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ রীতা দত্ত, সাংবাদিক গল্পকার বিপুল বড়ুয়া, প্রাবন্ধিক রেজাউল করিম স্বপন, পরিচালক এসএম মোখলেসুর রহমান। লেখাপাঠে অংশ নেন ছড়াকার উৎপলকান্তি বড়ুয়া, ছড়াকার জসীম মেহবুব, ছড়াকার সৈয়দ খালেদুল আনোয়ার, কবি সৈয়দা সেলিমা আক্তার প্রমুখ।