
উৎপল বড়ুয়া, সিলেট
সিলেট বিভাগজুড়ে প্রতিনিয়ত বেড়েছে পারিবারিক ও সামাজিক সহিংসতা। তুচ্ছ ঘটনায় ঘটছে খুনোখুনি। পরিবার ও স্বজনদের হাতে প্রাণ দিতে হচ্ছে আপনজনকে। আইনশৃঙ্খলাবাহিনী ও সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, সামাজিক অস্থিরতা, অসহিষ্ণুতা, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আস্থাহীনতা, সর্বোপরি নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়ের কারণেই বাড়ছে এমন খুনোখুনি। সামাজিক সচেতনতা ও নৈতিক মূল্যবোধ বৃদ্ধি ছাড়া এই সহিংসতারোধ সম্ভব নয় বলে মন্তব্য তাদের।
গত ১৯ জুন দিবাগত রাতে সিলেটের ওসমানীনগর উপজেলার সোয়াইরগাঁও গ্রামে নিজবাড়ি থেকে স্কুলশিক্ষিকা তপতী রাণী দে’র গলাকাটা ও গৃহকর্মী গৌরাঙ্গ বৈদ্যের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশের ধারণা কোন ক্ষোভ থেকেই গৃহকর্মী গৌরাঙ্গ গৃহকর্ত্রী তপতীকে খুন করে নিজে আত্মহত্যা করেছে। প্রায় ৭ বছর ধরে গৌরাঙ্গ ওই বাড়িতে থেকে গৃহস্থালীর কাজ করে আসছিল। এর চারদিন আগে গত ১৬ জুন গোয়াইনঘাট উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নের বিন্নাকান্দি গ্রামে নিজ বাড়ি থেকে মা ও দুই শিশু সন্তানের জবাই করা লাশ উদ্ধার করা হয়। আহতাবস্থায় উদ্ধার করা হয় গৃহকর্তা হিফজুর রহমানকে।
পরে পুলিশী তদন্তে বের হয় পারিবারিক বিরোধের জের ধরে গৃহকর্তা হিফজুরই গলাকেটে ও কুপিয়ে স্ত্রী আলেমা বেগম, ১০ বছরের ছেলে মিজানুর রহমান ও ৩ বছরের মেয়ে আনিশাকে খুন করেছে। পরে নিজের শরীরে কয়েকটি আঘাত করে আহতের ভান ধরেছিল। বর্তমানে হিফজুর পুলিশ রিমান্ডে রয়েছে। গত ১৯ জুন রাতে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান ছাতকের ছাতারপই গ্রামের আব্দুল আলীর ছেলে তাজ উদ্দিন আহমদ।
ওইদিন সকাল ৮টায় তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন নগরীর উপশহরের বাসা থেকে তাকে এনে হাসপাতালে ভর্তি করেন। ওইসময় শ্বশুরবাড়ির লোকজন জানান, তাজ উদ্দিন বিষপান করেছেন। তবে তাজের পরিবারের অভিযোগ, শ্বশুরবাড়ির লোকজন বিষপান করিয়ে তাকে খুন করেছেন।
১২ জুন হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার মেহেরপুরে গৃহবধূ নিপা আক্তারকে গলাকেটে হত্যা করেন তার স্বামী। পারিবারিক কলহের জের ধরে স্বামীর হাতে প্রাণ দিতে হয় নিপাকে। ৯ জুন জগন্নাথপুরের সৈয়দপুর শাহারপাড়া ইউনিয়নের গোয়ালগাঁও গ্রামে পারিবারিক বিরোধের জের ধরে মাদ্রাসা ছাত্রী সানজিদা আক্তারকে গলাটিপে হত্যা করেন তার আপন চাচা। মে মাসের মাঝামাঝি হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার মক্রমপুর ইউনিয়নের নিশ্চিন্তপুর গ্রামে অন্যকে ফাঁসাতে গিয়ে নিজের মা গোলাপজান বিবিকে হত্যা করে ছেলে মোহাম্মদ আলী। বাড়ির সীমানা নিয়ে বিরোধকে কেন্দ্র করে মাকে হত্যা করে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে চেয়েছিল মোহাম্মদ আলী। কিন্তু পুলিশী তদন্তে তা ফাঁস হয়ে যায়।
গত ৯ মে সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জে বিদ্যুতের খুটি বসানোকে কেন্দ্র করে চাচাতো ভাই রাসেল মিয়া ঘরে ঢুকে ছুরিকাঘাত করে খুন করে আলমগীর হোসেন ও তার স্ত্রী মোর্শেদা বেগমকে। এছাড়া গত ৩০ এপ্রিল নগরীর তালতলায় ঘুমের ঔষধ খাইয়ে স্বামী এডভোকেট আনোয়ার হোসেনকে খুন করেন শিপা বেগম। প্রথমে আনোয়ারের মৃত্যু স্বাভাবিক বলে চালিয়ে দেন শিপা। কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর ১০ দিনের মাথায় পরকিয়া প্রেমিক শাহাজাহান চৌধুরীকে বিয়ে করলে আনোয়ারের পরিবারের লোকজনের সন্দেহ হলে তারা মামলা দায়ের করেন। পরে শিপা আদালতে স্বামী হত্যার কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দেন। এছাড়াও সিলেট বিভাগে প্রতিদিনই ঘটছে এমন সহিংসতার ঘটনা। স্বজনদের হাতে প্রাণ দিতে হচ্ছে আপনজনদের।
এরকম সহিংসতার জন্য সামাজিক অস্থিরতা, পরিবারে লোকজনের মধ্যে আস্থার অভাব ও নৈতিক অবক্ষয়কে দায়ি করে সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি কার্যালয়ের পুলিশ সুপার (ক্রাইম এন্ড মিডিয়া এনালাইসিস) জেদান আল মুসা বলেন, নৈতিক মূল্যবোধ ও সামাজিক সহিষ্ণুতা বৃদ্ধি করা না গেলে পারিবারিক ও সামাজিক সহিংসতা রোধ সম্ভব নয়।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মো. জসিম উদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, করোনার কারণে সাধারণ মানুষের কাজের জায়গা সংকীর্ণ হয়ে আসছে। দারিদ্র্যতাও বাড়ছে। স্বাভাবিক চলাফেরায় নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে হতাশা বাড়ছে। দীর্ঘক্ষণ ঘরে থাকার ফলে ছোটখাটো বিষয় থেকে বিরোধ সৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়া এই অস্থিরতার জন্য অধ্যাপক জসিম সামাজিক ও ধর্মীয় অনুশাসন থেকে দূরে চলে যাওয়াকেও দায়ি করেন।