
রতন বড়ুয়া : চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার প্রাচীন ঐতিহ্যে মৃৎশিল্প অর্থাৎ মাটির তৈরি জিনিসপত্র এখন বিলুপ্তির পথে। সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, মাটি ও উপকরণ সংকট, তৈরি ব্যয় বেড়ে যাওয়া, লাভজনক না হওয়া ও বাজারে প্লাস্টিকের তৈরি বিভিন্ন ব্যবহারিক জিনিসপত্রে সয়লাব হওয়ায় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে দেশের এক সময়ের চিরচেনা মৃৎশিল্প।
ইতিহাস৭১ টিভি’র প্রতিবেদক সরেজমিন দেখা গেছে, পটিয়া উপজেলার মৃৎশিল্প তৈরির কারিগর কুমার সম্প্রদায়ের পরিবারগুলোর সদস্যদের মাঝে চলছে নানা অভাব-অনটন ও চরম হতাশা।
তারা এখন বেকার সময় কাটাচ্ছে। কারণ তাদের তৈরি মাটির পণ্য এখন বাজারে বিক্রি না হওয়ায় বদলে যাচ্ছে কুমার পাড়ার জীবনের চালচিত্র।
বিস্তারীত জানা যায়, পটিয়া উপজেলার কচুয়াই ইউনিয়নের আজিমপুর এলাকাৱ রুদ্রপাড়ায় এ পেশার সঙ্গে জড়িত ছিল প্রায় শতাধিক পরিবার। বর্তমানে হাতেগোনা ৭-৯ পরিবার কোনো রকমে পূর্বপুরুষের ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে মৃৎশিল্প তৈরি করছে।
তাদের পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন স্থানে হাটে-বাজারে, দোকানে ও মেলায় অংশ নেয়ার জন্য আগে থেকেই তৈরি করে রাখত মাটির তৈরি হাঁড়ি-পাতিল, বাসন, ছোট ছোট পুতুল ও খেলনা। পরিবারের নারী সদস্যরা রঙের কাজে এখন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে।
এক সময় মৃৎশিল্পের খ্যাতি ছিল দেশজুড়ে। কিন্তু আজকাল প্লাস্টিক, অ্যালুমিনিয়াম, চীনামাটি, মেলামাইন এবং বিশেষ করে সিলভারে রান্নার হাঁড়ি কড়াই প্রচুর উৎপাদন ও ব্যবহারের ফলে মৃৎশিল্প হারিয়ে যেতে বসেছে।
অতীতে এমন দিন ছিল যখন গ্রামের মানুষ দৈনন্দিন ব্যবহারে এই মাটির হাঁড়ি-পাতিল, কলসি, কড়াই, থালা-বাসন, মালশা ইত্যাদি মাটির তৈরি উপকরণ ব্যবহার করত। এক সময়ে পটিয়ার আজীমপূর এলাকার রুদ্রপাড়া(কুমাৱ পাড়া) ছিল মাটির তৈরি পণ্যসামগ্রীর সমাহার।
বিভিন্ন হাটে-বাজারে ছিল মাটির তৈরি হাঁড়ি-পাতিলসহ অন্যান্য সামগ্রীর দোকান। কিন্তু পটিয়ায় এখন কুমারদের আর হাঁড়ি-পাতিলের দোকান নেই। তারা বাড়িঘরে বানানোর পর সেখান থেকে ক্রেতারা এসে নিয়ে যায়।
এ এলাকার বাসিন্দা মৃৎশিল্প কারিগর রাখাল রুদ্র জানায়, তার বাপ-দাদারা যুগ যুগ ধরে এ পেশায় যুক্ত ছিল। বিভিন্ন জায়গা থেকে মাটি এনে নানা ধরনের ব্যবহার সামগ্রী বানাত এবং তা হাটে-বাজারে বিক্রি করে জীবিকানির্বাহ করত।
কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের ফলে এসব পণ্য আজ হারিয়ে গেছে। প্লাস্টিক, অ্যালুমিনিয়াম, চীনামাটি, মেলামাইনসহ আধুনিক পণ্যসামগ্রী পাওয়ার পর মাটির তৈরি সামগ্রী আর কেউ নিতে চায় না, বিক্রিও তেমন হয় না।
তদুপরি যে পরিমাণ মজুরি ও খরচ পড়ে সে অনুযায়ী দাম পাওয়া যায় না। আবার রয়েছে মাটির স্বল্পতা। নেই সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। এ কারণে এখানকার শতাধিক পরিবার এখন এ পেশা ছেড়ে দিয়েছে।
মাত্র ৭-৯ পরিবার নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য কুমার সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য ধরে রাখতে এ পেশাটি আঁকড়ে রয়েছে।
আর এক মৃৎশিল্পী পলাশ রুদ্র জানায়, এক সময় পাড়ার অর্ধশতাধিক পরিবার এ পেশায় যুক্ত ছিল। তাদের ঘরে ঘরে মাটির ব্যবহার সামগ্রী তৈরি হতো। তখন অলিৱ হাটেৱ আশপাশেৱ এলাকায় হতো মেলা।
মাঘ মাসে অনুষ্ঠিত এ মেলায় বছরে একবার তারা এসব পণ্য বিক্রি করে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করত। এখন মেলা না হওয়ায় মাটির জিনিস বিক্রি হয় না। তাই এ পেশায় টিকে থাকা যাচ্ছে না।
তাই এ বদলে যাওয়া পৃথিবীতে প্রায় সবই নতুন রূপ। নতুন সাজে আবার নতুনভাবে এ সামগ্রী মানুষের কাছে ফিরে এসেছে। শুধু গ্রামে নয় শহরের শিক্ষিত সমাজও মাটির জিনিস ব্যবহার করছে। তবে তা বিচিত্ররূপে।
এখন মানুষের রুচি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নিত্যনতুন রূপ দিয়ে মৃৎশিল্পকে আকর্ষণীয় করে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে।
পটিয়ার মৃৎশিল্পীদের এসব ঐতিহ্য ধরে রাখতে হলে, গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য কুমার শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে ঘন ঘন মেলা বিভিন্ন স্থানে এসব পণ্যের প্রদর্শনী করা প্রয়োজন। তা ছাড়া সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের আওতায় আনা দরকার।