শুক্রবার-৯ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-২৬শে বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-১১ই জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি

বুদ্ধপূর্ণিমা’র তাৎপর্য ও করোনাময় বিশ্ব

 

লায়ন উজ্জ্বল কান্তি বড়ুয়া

শুভ বুদ্ধপূর্ণিমা ২৫৬৫ বুদ্ধবর্ষ। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব গৌতম বুদ্ধের জন্মগ্রহণ, বোধিজ্ঞান লাভ ও মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন বৈশাখী পূর্ণিমার এই মাহেন্দ্রক্ষণে। ত্রি-স্মৃতিবিজড়িত এই মহাপবিত্র দিনটিই বুদ্ধ পূর্ণিমা। খ্রিষ্টপূর্ব ৬২৩ অব্দে বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে তদানীন্তন ভারতবর্ষের বর্তমান নেপালে কপিলাবস্তুর লুম্বিনী কাননে শালতরুর সুশীতল ছায়ায় শাক্যরাজ শুদ্ধোধন’র ঔড়সে ও রাণী মহামায়া’র কোল আলো করে জন্ম নিয়েছিলেন রাজকুমার। জন্মের সাথে সাথে সপ্তপদ অগ্রসর হয়ে এ শিশু ঘোষণা দেন- “জগতে আমিই শ্রেষ্ঠ, আমিই জৈষ্ঠ্য এবং ইহাই আমার শেষ জন্ম”। রাজা শুদ্ধোধনের মনস্কামনা পূর্ণ হওয়ায় পুত্রের নাম রাখেন সিদ্ধার্থ। জন্মের সাতদিন পরই সিদ্ধার্থের মা রাণী মায়াদেবী ইহলোক ত্যাগ করেন। তখন মাসী মহাপ্রজাপতি গৌতমীকে সিদ্ধার্থের লালন-পালনের দায়িত্ব দেন, এ কারণে সিদ্ধার্থ “গৌতম” নামে পরিচিতি পান। সিদ্ধার্থ গৌতম ঊনত্রিশ বছর বয়সে গৃহত্যাগ করে বিখ্যাত ঋষি আরাড় কালাম ও রামপুত্র রুদ্রকসহ বিভিন্ন গুরুর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে মুক্তির পথ অন্বেষণ করতে থাকেন। কিন্তু তাঁদের নির্দেশিত পথে দীর্ঘ ছয় বছর কঠোর সাধনা করেও সত্য ধর্মের সন্ধান না পেয়ে কৃচ্ছতা সাধনের মাধ্যমে দিনাতিপাত করতে থাকেন। তাঁর এ কৃচ্ছতা সাধন দেখে পাঁচজন সন্ন্যাসী তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে তাঁকে গুরু হিসাবে ভক্তি-শ্রদ্ধা ও সেবা করতে লাগলেন। কিন্তু কৃচ্ছতা সাধনেও তিনি মুক্তির পথ অন্বেষণে ব্যর্থ হওয়ায় তা পরিহার করে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করে দৈনিক কিছু কিছু আহার করতে থাকেন। তাঁর এ মধ্যম পন্থা অবলম্বন দেখে পঞ্চশিষ্য গৌতম সাধনাভ্রষ্ট হয়েছেন ভেবে তাঁরা তাঁকে ত্যাগ করেন। অত:পর এক শুভদিনে সুজাতার দেয়া পায়েসান্ন ভোজন করে বুদ্ধগয়ার বোধিবৃক্ষমূলে বজ্রাসনে বসে সংকল্প করলেন সম্বোধি লাভ না করা অবধি এ আসন ত্যাগ করবেন না। বুদ্ধগয়ার বোধিবৃক্ষমূলে বজ্রাসনে কঠোর ধ্যান সাধনার মধ্য দিয়ে তাঁর পঁয়ত্রিশ বছর বয়ক্রমকালে এই বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতেই সম্যক সম্বুদ্ধত্বজ্ঞানে অধিষ্ঠিত হয়ে জ্ঞানের আধার বুদ্ধ রূপে আবির্ভূত হয়ে নির্বাণের পথ সুগম করেছিলেন। আর এই পূর্ণিমা তিথিতেই গৌতম বুদ্ধ আশি বছর বয়সে কুশিনগরের যমক শালবৃক্ষের নীচে চিরনিদ্রায় শায়িত হয়ে মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন। সঠিকভাবে বললে আজ থেকে (২৫৬৫+৮০)= ২৬৪৫ বছর পূর্বে এই ধরণীতে মহামানব গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাব ঘটে। ঊনত্রিশ বছর গৃহী জীবন, ছয় বছর আত্মমুক্তির সন্ধানে কঠোর সাধনার মাধ্যমে বোধিজ্ঞান লাভ, পঁয়তাল্লিশ বছর মানব মুক্তির লক্ষে তাঁর নবলব্দ ধর্ম প্রচার করে আশি বছর বয়সে মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন।। সম্যক সম্বুদ্ধের বর্ণাঢ্য জীবনের ত্রি-স্মৃতিবিজড়িত বুদ্ধপূর্ণিমা (বৈশাখী পূর্ণিমা) হতে আরেকটি শিক্ষা নিতে পারি। তিনি জন্ম নিয়েছেন লুম্বিনী উদ্যানে শালতরুর ছায়ায়, রাজপুত্র হয়েও উন্মুক্ত আকাশের নীচে তাঁর জন্ম। বুদ্ধত্ব লাভ গয়ার বোধিবৃক্ষের নীচে। আবার মহাপরিনির্বাণ কুশীনারার যমক শালবৃক্ষের নীচে। এ বিষয় হতে চিন্তা করতে পারি, তিনি তাঁর জীবনে উন্মুক্ত আকাশ, বৃক্ষতল, পূর্ণিমা তিথি ইত্যাদিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তাই বুদ্ধের আবিষ্কৃত ধর্ম ও জীবনাচরণ সবার জীবনে প্রতিফলন ঘটাতে হবে। জীবনকে বিকশিত করতে হলে বুদ্ধ আবিষ্কৃত চতুরার্য সত্যের চতুর্থ সত্য আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গের অনুশীলন করতে হবে। তাঁর জীবন-দর্শনে ছিল অহিংসা, ক্ষমা, দয়া, সাম্য, মৈত্রী, প্রীতি, সহনশীলতা, সহমর্মিতা, পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সৌভ্রাতৃত্ববোধ। এসব আদর্শকে ধারণ করেলে প্রতিয়মান হয় যে, জগতে শত্রুতার দ্বারা কখনো শত্রুতার উপশম হয় না, মিত্রতার দ্বারাই শত্রুতার উপশম হয়। বুদ্ধের অমিয় বাণী থেকে স্পষ্ট ধারণা পাই, মানবজীবন থেকে যদি লোভ, হিংসা, ঘৃণা, বিদ্বেষ, ক্রোধ, পাপ, মোহ, মিথ্যা যাবতীয় কলুষিত বিষয়গুলো দূর করা যায়, তাহলে প্রকৃত সুখ লাভ করা সম্ভব হবে এবং সুন্দর, শান্তিময় পৃথিবী প্রতিষ্ঠিত হবে। বৌদ্ধ নীতিশাস্ত্রের আর একটি স্থম্ভ হলো পঞ্চশীল। বুদ্ধ গৃহীদের জন্য শীল পালনে গুরুত্বারোপ করেন। পঞ্চশীলে বলা হয়েছে, প্রাণী হত্যা থেকে বিরত, চৌর্যবৃত্তি না করা, মিথ্যা কথা না বলা, অবৈধ কামাচার হতে বিরত থাকা এবং কোনো ধরনের নেশাদ্রব্য সেবন না করা। একজন মানুষ যে কোন ধর্মেরই হোক, তার জীবনাচরণে যদি পঞ্চশীলের প্রতিফলন ঘটাতে পারে তবেই সে একজন প্রকৃত মানুষ হতে পারবে। চলুন আমরা বুদ্ধের অমিয় বাণী থেকে শিক্ষা নিয়ে সব ধরণের অশালীন কর্ম থেকে দূরে থাকি, সব প্রাণীর প্রতি মহত্ত্ববোধ সৃষ্টি করি, পরিবেশের প্রতি যত্নশীল হই, তাহলে ব্যক্তি থেকে বিশ্বে শান্তি বর্ষিত হবে। বর্তমান সময়ে বুদ্ধ বাণীর প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে। তথাগত বুদ্ধের জীবদ্দশায় বিত্তশালী বৈশালী নগরে হঠাৎ অনাবৃষ্টির কারণে শস্য নষ্ট হয়ে যায় এবং সে সময়ে দুর্ভিক্ষ দেখা যায়। ফসল হারিয়ে ও খাদ্যাভাবে অগণিত মানুষের প্রাণহানি হয়। মৃত্যুর সংখ্যা এত বেশী ছিল যে, যা সৎকার করা কঠিন ছিল! মৃতদেহ এখানে-সেখানে পড়ে থাকায় রোগ-জীবাণু ছড়িয়ে পড়েছিল। বুদ্ধ তখন এ রকম সংবাদ শুনে বৈশালী নগরে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। সে মুহূর্তে নগরে ভারী বর্ষণ হয়ে সব ধুয়েমুছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। যাওয়ার পরে বুদ্ধ তাঁর সেবক আনন্দকে রতন সূত্র আবৃত্তি করতে এবং বুদ্ধের ভিক্ষাপাত্র থেকে জল ছিটিয়ে দিতে বলেন। বুদ্ধের কথামতো সেবক আনন্দ কাজ করলে তখন বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘ গুণের প্রভাবে ওই সময়ে বৈশালীতে রোগমুক্তি এবং দুর্ভিক্ষ প্রশমিত হয়েছিল। এখানে লক্ষ করলে বোঝা যায়, যেকোনো মহামারিতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা প্রয়োজন। সেটার ইঙ্গিত রয়েছে রতন সূত্রের প্রেক্ষাপটে। যেমনটা করোনা থেকে বাঁচতে হলে অন্যতম কাজ নিজেকে ও চারপাশের পরিবেশকে পরিষ্কার রাখা। সুতরাং সবার প্রয়োজন সুরক্ষিত ও সচেতন থাকা। আসুন আমরা মহামারী করোনা কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাব থেকে মুক্ত থাকতে সরকার ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা মেনে চলি।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on telegram
Telegram
Share on skype
Skype