রবিবার-১৬ই মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-২রা চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-১৬ই রমজান, ১৪৪৬ হিজরি

ব্রিটিশ রাজার বর্ণাঢ্য অভিষেক

আন্তর্জাতিক ডেস্ক :

বিশ্বের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান ঘিরে আগ্রহ তৈরি হয় ছয় মাস ধরে। এমন জমকালো অনুষ্ঠানের জন্য তৈরি ছিলেন ব্রিটেনের কোটি মানুষ, তৈরি ছিলেন পৃথিবীর শত কোটি মানুষ। এমন দৃশ্য বিরল। ব্রিটেন পেয়েছে গত ৭০ বছরে একবার, ৬ মে ২০২৩, শনিবার।

ইতিহাসের পাতায় চির অমর একটি দিন। এই দিনে ব্রিটেনের রাজা তৃতীয় চার্লস আনুষ্ঠানিক রাজার দায়িত্ব নিয়েছেন।
এমন নিখুঁত অনুষ্ঠান খুব কমই দেখেছে পৃথিবী, প্রতিটি সেকেন্ড হিসাবে বন্দি, প্রতিটি পদক্ষেপ মাপা। কখন অশ্বারোহী বাহিনী কত সময় ধরে হাঁটবে, কতটুকু গতিতে মার্চ করবে ৪ হাজার সুসজ্জিত পদাতিক বাহিনী সব চুলচেরা সময়ে বন্দি ছিল।

এমন কঠোর নিয়মে বন্দি অনুষ্ঠান যা বিরূপ আবহাওয়াকে তোয়াক্কা না করে নিজস্ব গতিতেই এগিয়েছে। বৃষ্টি ছিল, তাতে কী? এমন দিনে কীভাবে আনন্দ করতে হয় তা দেখাতেই উন্মাদ ব্রিটিশরা নেমেছিলেন রাজপথে। তারা শুভেচ্ছা জানিয়েছেন রাজাকে। সকাল ৬টা থেকেই সাজ সাজ রবে মানুষ চলে আসে এই বাকিংহাম প্যালেসমুখী।
তারও তিন দিন আগে থেকে মানুষ জড়ো হয়েছিল সেখানে, তাঁবু টাঙিয়ে। সুদূর কানাডা থেকে শুরু করে অস্ট্রেলিয়া থেকেও এসেছিলেন অনেকে। তাঁবু টাঙিয়ে ছিলেন শুধু কয়েক সেকেন্ডের জন্য রাজাকে দেখার অভিপ্রায় নিয়ে।
ঠিক ১০টা ২০ মিনিটে শুরু হয় বাকিংহাম প্যালেস থেকে রাজা ও রানিকে নিয়ে সুসজ্জিত বহরের ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে পর্যন্ত যাত্রা। সুসজ্জিত অশ্বারোহী বাহিনী, সুসজ্জিত সেনা দলবেষ্টিত শোভাযাত্রা ছুটে চলে দ্য মল অ্যাডামাইরিলিটি আর্চ, হোয়াইটহল পার্লামেন্ট স্ট্রিটের উত্তর ও দক্ষিণ দিক হয়ে প্রদক্ষিণ করে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে।

এ যাত্রাটি করা হয় ডায়মন্ড জুবিলি কোচে করে, যেটি ২০১২ সালে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের সিংহাসন আরোহণের ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে তৈরি করা হয়।
ঠিক ১০টা ৫৪ মিনিটে রাজা ও রানি পৌঁছান ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে। ঘড়িতে ১১টা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই রাজার রাজ্যাভিষেকের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছেন ব্রিটেনের শীর্ষ ধর্মীয় গুরু আর্চ বিশপ অব ক্যান্টারবারি জাস্টিন ওয়েলবি। অনুষ্ঠানটি সরাসরি দেখার সুযোগ পেয়েছেন মাত্র ২ হাজার ৩০০ অতিথি। এর মধ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছিলেন আমন্ত্রিত অতিথি। আর সারা পৃথিবীর ১০০ কোটিরও বেশি মানুষ দেখেছেন টিভিতে বসে। শপথ গ্রহণে হাজার বছরের ঐতিহ্যকে ধরে রাখা হয়েছে। যেমন প্রথমে রাজাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন আর্চ বিশপ অব ক্যান্টারবারি। রাজা যখন করোনেশন চেয়ারের সামনে দাঁড়ান তখন এই ধর্মীয় গুরু বলে ওঠেন, গড সেভ দ্য কিং! একই সঙ্গে বাদ্য বেজে ওঠে। এরপর শুরু হয় শপথ গ্রহণ। শপথে রাজা তৃতীয় চার্লস চার্চ অব ইংল্যান্ড ও ব্রিটিশ আইন সমুন্নত রাখার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছেন।

ব্রিটিশ রাজা চার্লসের রাজ্যাভিষেক হলো গতকাল। ঐতিহ্যবাহী বর্ণাঢ্য আয়োজনে তিনি সিংহাসনে আরোহণ করলেন -এএফপি

এ আনুষ্ঠানিকতায় এরপর রাজাকে অভিষিক্ত করা হয় রাজার চেয়ারে বসিয়ে। একই সঙ্গে সোনায় মোড়ানো কাপড় দিয়ে রাজাকে আচ্ছাদিত করা হয়। একই সময়ে রাজাকে পবিত্র তেল হাতে মাখিয়ে দেন আর্চ বিশপ অব ক্যান্টারবারি। তারপর তুলে দেওয়া হয় রাজার হাতে রাজদণ্ডসহ রাজ গোলক। এগুলো মানবতা, ধর্মীয় অনুশাসন, ক্ষমতা, বিচার, ক্ষমা ইত্যাদির প্রতীক। সর্বশেষ রাজার মাথায় আর্চ বিশপ পরিয়ে দেন মুকুট। এই মুকুট ৩৬০ বছরের পুরনো, সেন্ট এডওয়ার্ডের মুকুট। ২২ ক্যারেট সোনা দিয়ে বানানো এই মুকুটের ওজন ২ কেজি ২৩ গ্রাম। এই মুকুটে রয়েছে ৪৪৪টি মণি-মুক্তা, নীলকান্ত পাথর ইত্যাদি।

রাজা মাথায় মুকুট পরে চেয়ার থেকে রাজদণ্ডের দিকে এগিয়েছেন। এ সময় সবাই মিলে রাজাকে কুর্নিশ করেছেন। একইভাবে রানির মাথায় মুকুট তুলে তাঁকেও কুইন কনসর্ট হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের রাজ্যাভিষেক ছিল তিন ঘণ্টাব্যাপী। তবে রাজা তৃতীয় চার্লসের অভিষেক অনুষ্ঠান শেষ হয় দুপুর ১টায়। এরপরই নতুন অভিষিক্ত রাজা ও রানি ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে ত্যাগ করেন। ১টা ৩০ মিনিটে রাজা ফিরে আসেন বাকিংহাম প্যালেসে। এই ফিরে আসায় ব্যবহৃত হয় প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো গোল্ড স্টেইট কোচ। এটি প্রায় ৪ টন ওজনের। এই গাড়িটি টেনে নিয়ে যায় আট ঘোড়ার পদাতিক বাহিনী।

এরপর দুপুর ২টা ১৫ মিনিটে রাজা তৃতীয় চার্লস ও পরিবারের সদস্যরা এসে দাঁড়ান বেলকনিতে। বেলকনিতে ছিলেন ব্রিটেনের নতুন রাজা তৃতীয় চার্লস, রানি ক্যামিলা, প্রিন্স উইলিয়াম, প্রিন্সেস ক্যাট ও তাদের তিন সন্তান। তবে এই আনুষ্ঠানিকতায় ছিলেন না প্রিন্স হ্যারি। তিনি রাজার সন্তান হলেও রাজপরিবারের কেউ নন। তাই প্রিন্স হ্যারি এই আনুষ্ঠানিকতায় ছিলেন না। এমনকি তিনি শোভাযাত্রায় অংশ নেননি, পরতে পারেননি রাজকীয় পোশাক। তিনি সাধারণ অতিথির মতোই এসেছিলেন, বসেছিলেন ভাই উইলিয়ামের সারি থেকে অন্তত তিন সারি পেছনে। একেবারেই সাধারণ আমন্ত্রিত অতিথির মতোই ছিলেন তিনি। রাজার সঙ্গে বেলকনিতে আরও উপস্থিত ছিলেন প্রিন্সেস অ্যান, প্রিন্স এডওয়ার্ডসহ রাজপরিবারের সদস্যরা। এ সময় বাকিংহাম প্যালেসের সামনে থাকা লাখ লাখ মানুষ উল্লাসে ফেটে পড়ে। এরই মধ্য দিয়ে রাজার অভিষেকের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়। তারপর সন্ধ্যায় হয় কনসার্ট। ৭ মে সারা দেশে চলবে রাজ্যাভিষেকের স্ট্রিট পার্টি। ৭০ বছর পর পৃথিবীর সবচেয়ে অভিজাত রাজপরিবারের রাজার অভিষেক দেখল কোটি কোটি মানুষ। রাজা শপথ নিয়েছেন ব্রিটেনের আইন ও চার্চ অব ইংল্যান্ড সমুন্নত রাখার জন্য। তিনি কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ রাখবেন এমন প্রত্যাশা করছেন সবাই।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on telegram
Telegram
Share on skype
Skype