শনিবার-১০ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-২৭শে বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-১২ই জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি

হাইকোর্টের নির্দেশ চট্টগ্রামে পাহাড় কেটে তৈরি করা ঘরগুলো ভেঙে ফেলার

বাংলাদেশ হাইকোর্ট। ফাইল ছবি।

ইতিহাস ৭১ নিউজ ডেস্ক : হাইকোর্টের নির্দেশ চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামী, আকবরশাহ, খুলশীসহ বিভিন্ন এলাকায় নির্বিচারে পাহাড় কেটে তৈরি করা ঘর ও অন্যান্য স্থাপনা ভেঙে ফেলার। এবং পরিবেশ অধিদপ্তর, চট্টগ্রামের পরিচালক ও জেলা প্রশাসককে (ডিসি) সার্বক্ষণিক তদারকির করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

৭ আগস্ট (রোববার) মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের করা (এইচআরপিবি) এ সংক্রান্ত রিটের শুনানি শেষে হাইকোর্টের বিচাপতি মজিবুর রহমান মিয়া ও কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দ এ নির্দেশ দেন। এতে তিন মাস পরপর এ বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিল করার জন্যও বলা হয়েছে।

পাহাড় কেটে ঘর-স্থাপনা তৈরির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের ১৫ ধারায় আইনী ব্যবস্থা নেওয়ারও নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে, পরিবেশ অধিদপ্তর, চট্টগ্রামের পরিচালক ও ডিসিকে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়ে আগামী একমাসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে রুলও জারি করেছেন আদালত। রুলে পাহাড় কেটে ঘর ও অন্যান্য স্থাপনা তৈরি বন্ধে প্রশাসনের ব্যর্থতা ও নিস্কৃয়তা কেন বেআইনী ও অবৈধ ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চাওয়া হয়েছে। এছাড়া, রুলে পাহাড় কাটা বন্ধে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, আর কর্তনকৃত পাহাড় আগের রূপে ফিরিয়ে আনার নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না রুলে তাও জানতে চাওয়া হয়েছে।

আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন এইচআরপিবির চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুর্টি অ্যাটর্নি জেনারেল অরবিন্দ রায়।

বায়েজিদ বোস্তামীতে পাহাড় কেটে বানানো প্লটে দালান নির্মাণ করে পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ নেওয়া হয়েছে। এমনকি, প্লটের নিরাপত্তায় সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে অভিযোগ তুলে গত ১ আগস্ট হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিট করা হয়। ওই রিটের শুনানি নিয়ে এই আদেশ দেন।

রিটে গত ২৬ জুলাই একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত ‘চট্টগ্রামে পাহাড়ে লোভের কোপ/ পাহাড় কেটে প্লট, উঠছে দালান’শীর্ষক প্রতিবেদ সংযুক্ত করা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, অভিযোগ রয়েছে, পাহাড়ে অবৈধভাবে নির্মিত দালানের বাসিন্দারা পরিবেশ অধিদপ্তরের লোকজনদের নিয়মিত উৎকাচ দেন। উৎকাচ না পেলেই অভিযান পরিচালনা করেন পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।

এদিকে, পরিবেশ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসন বলছে, তারা অভিযোগ পেলেই অভিযান চালাচ্ছে। তবে খুব একটা লাভ হচ্ছে না। কারণ অভিযান বন্ধ হলেই আবার পাহাড় কাটা হচ্ছে।

২ জুলাই বায়েজিদ বোস্তামী থানার মাঝিরঘোনায় গিয়ে দেখা যায়, লিংক রোড থেকে ডান পাশে একটি সড়ক নেমে গেছে। সড়কমুখে ইটের দেয়ালে সাঁটানো লিফলেটে লেখা, ‘সার্বক্ষণিক সিসিটিভি ক্যামেরায় নজরদারি চলছে।’ একটু দূরেই চোখে পড়ল গাছে লাগানো সিসিটিভি ক্যামেরা।

আরও সামনে পাহাড় কেটে তৈরি হয়েছে ‘গলাচিপা’ নামক সড়ক। ভরদুপুরে ঝিরিপথের ওই প্রান্তে দেখা গেল, পাহাড়ে পড়া কোপে সদ্য বেরিয়ে আসা মাটি। অপরিচিত লোক দেখেই সরে যান পাহাড় কাটার কাজ তদারককারীরা। সেখানকার সব পাহাড়েই কোপ পড়েছে। উঠেছে ঘর, নির্ধারণ করা হয়েছে প্লটের সীমানা।

পাহাড়ে অবৈধভাবে ঝুঁকিপূর্ণ বসতঘর নির্মাণ প্রসঙ্গে বায়েজিদ বোস্তামী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, দুর্গম পাহাড়ে নির্জনতার সুযোগে প্রতিনিয়তই পাহাড় কাটা হচ্ছে। গত জুনে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে উচ্ছেদ অভিযান চালানোর পর আবারও চলছে ঘর নির্মাণের কাজ।

একই কায়দায় পাহাড় কাটা হচ্ছে আকবরশাহ থানার ১ নম্বর ঝিল, সলিমপুর এলাকায়। নগরীর ভেতরে চকবাজার থানা এলাকার ম্যানিলা হিল আংশিক কেটে ফেলা হয়েছে।

পরিবেশ অধিদপ্তর ম্যানিলা হিল থেকে কয়েকজন পাহাড় কর্তনকারী শ্রমিককে আটক করেছিল। অভিযোগ আছে, পরিবেশ অধিদপ্তরের জ্ঞাতসারেই ম্যানিলা পাহাড় কাটা হচ্ছিল।

চট্টগ্রামের ডিসি মো. মমিনুর রহমান বলেন, পাহাড়ে শত শত ঘরে হাজারও মানুষের বসবাস। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে প্রশাসনের পক্ষ থেকে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়, কিন্তু অভিযান শেষ হলেই বাসিন্দারা আবার ফিরে আসেন। তাই এখন বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে পাহাড় রক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

বায়েজিদ বোস্তামীতে ‘মাঝেরঘোনা সমাজকল্যাণ হাউজিং সোসাইটি’র সঙ্গে জড়িত ১২ জনের নাম পাওয়া গেছে। বায়েজিদ বোস্তামী থানার তথ্য অনুযায়ী, এ সোসাইটির জন্য পাহাড় কেটেছেন শাহজাহান ওরফে লাল বাদশা, মো. জামাল, সোসাইটির সভাপতি মো. আরিফ হোসেন, আজিজুল হক, কামাল, জাহাঙ্গীর, আতিক, রড মানিক, অংশি মারমা, সাকিব, খালেক ওরফে মানিক ও নাছির।

তারা প্রত্যেকেই চার থেকে ১২টি মামলার আসামি। পাহাড় কাটার শ্রমিক সরবরাহ করেন বাদশা ও আরিফ। নিজের নামে বৈদ্যুতিক মিটারের সংযোগ নিয়ে অন্য ঘরে সরবরাহ করেন বাদশা। ইন্টারনেট সংযোগ দেন আবদুল খালেক। পাহাড় কেটে ১ হাজার ৬০০ বর্গফুটের প্লট তিন থেকে ছয় লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়। হাউজিংয়ে পানি সরবরাহ করেন বাদশা, কামাল, এয়ার মোহাম্মদ ও রড মানিক।

আকবরশাহ থানার ১ নম্বর ঝিলের বাসিন্দাদের ভাষ্যমতে, পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা পাহাড় পরিদর্শনে যান না। অতিবর্ষণের সময় জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেট উদ্ধার কার্যক্রম চালান। পরিবেশ অধিদপ্তরের নোটিশ জারিকারকসহ কিছু নিম্নপদের কর্মচারী টাকা হাতিয়ে নেন দালালদের মাধ্যমে।

মাঝেরঘোনার বাসিন্দারা বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের লোকজনকে নিয়মিত টাকা পাঠাতে হয়। টাকা না পাঠালে ম্যাজিস্ট্রেট-পুলিশ নিয়ে ঘর ভেঙে দেন।

সেখানকার আরেক বাসিন্দা হাবিব মোল্লা বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের লোকজনের কাছে সরাসরি টাকা দিই না। সমিতির মাধ্যমে টাকা পৌঁছে দেওয়া হয়।

সরকারি সংস্থার মধ্যে পাহাড় কেটেছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। ফৌজদারহাট-বায়েজিদ লিংক সড়ক নির্মাণ করতে ১৫টি পাহাড় কাটা হয়েছে। খাড়া করে পাহাড় কেটে সড়ক তৈরির পর সংস্থাটি এখন বলছে, ঝুঁকিমুক্ত করতে আবারও পাহাড় কাটা প্রয়োজন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক এস এম সিরাজুল হকের ‘হিল কাটিং অ্যান্ড অ্যারাউন্ড চিটাগং সিটি’ শিরোনামের গবেষণাপত্রে বলা হয়, বায়েজিদ বোস্তামী, খুলশী, পাহাড়তলী, মতিঝর্না, ষোলশহর ও ফয়েজ লেক এলাকায় সর্বাধিক পাহাড় কাটা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি পাহাড় কাটা হয়েছে পাঁচলাইশে।

চবির বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, মহানগরীতে বর্ধিত জনসংখ্যার চাপ সামাল দিতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের লোকজন পাহাড় নিধন করছেন। নাসিরাবাদ ও পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকা হয়েছে পাহাড় কেটে।

‘পাহাড়চূড়ায় বাংলো বানিয়ে সরকারি কর্মকর্তারা বসবাস করছেন। আর প্রভাবশালী পাহাড়খাদকরা পাহাড় কাটছেন। এমন নিধনযজ্ঞ চললে এই শতকের শেষের দিকেই হয়তো মরুভূমিতে পরিণত হবে চট্টগ্রাম।’

এম.জে.আর

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on telegram
Telegram
Share on skype
Skype