শনিবার-১০ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-২৭শে বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-১২ই জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি

পদ্মা সেতু: আত্মনির্ভর বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি ও একজন শেখ হাসিনা

অধ্যাপক উত্তম কুমার বড়ুয়া :   ‘পদ্মার ঢেউরে, মোর শূন্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যারে’- পদ্মার নৈসর্গিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কাজী নজরুল ইসলামের গানে, লেখনীতে উঠে এসেছে অনুপম ব্যঞ্জনায়। ভুপেন হাজারিকার হৃদয় ছোঁয়া সেই বিখ্যাত গান – “গঙ্গা আমার মা, পদ্মা আমার মা, ও আমার দু’চোখে দুই জলের ধারা মেঘনা-যমুনা” আমাদের স্বদেশ প্রেমে উজ্জীবিত করে।

মরমী শিল্পী আব্দুল আলিমের কণ্ঠে ভেসে উঠে – “সর্বনাশা পদ্মা নদী/তর কাছে সুধাই” কিংবা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাস, “পদ্মা নদীর মাঝি” পদ্মা নদীর দুপাড়ের মানুষের সংগ্রামী জীবনকে ফুটিয়ে তুলেছে। কৃত্তিবাস থেকে কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথের ‘ছিন্নপত্র’ পর্যন্ত প্রায় সকল কবি সাহিত্যিকরা পদ্মা নদী দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন।

সুপ্রাচীন গ্রন্থ ‘চর্যাপদ’-এ উৎকীর্ণ খরস্রোতা পদ্মার বিচিত্র আখ্যান। হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপন্ন ভারতের গঙ্গা নদীর প্রধান শাখা, যাকে গঙ্গা তনয়াও বলা হয়ে থাকে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে নদীটি ‘পদ্মা’ নামধারণ করেছে। পদ্মা-মেঘনার সঙ্গম স্থলের পরবর্তী মিলিত প্রবাহই ‘পদ্মা’ নামে অবহিত।

পদ্মার উৎস থেকে ২২০০ কি:মি: (১৪০০মাইল) দুরে গোয়ালন্দে যমুনার সাথে মিলিত হয়ে পদ্মা নামে পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে চাঁদপুরে মেঘনা হিসাবে নামকরণ হয়ে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের সাথে মিশে গেছে। পদ্মা নদীর দৈর্ঘ্য ১২০ কি:মি: (৭৫ মাইল), প্রস্থ ১০ কি:মি, পদ্মার সর্বোচ্চ গভীরতা ১৫৭১ ফুট (৪৭৯মিটার) যার গড় গভীরতা ৯৬৮ ফুট (২৯৫ মিটার) এবং অববাহিকা প্রায় ৮০ বর্গ কি:মি: (৩১ বর্গ মাইল)।

বলা রাখা দরকার, গঙ্গা ও পদ্মা বাঙালির চিরায়ত সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। গঙ্গা-পদ্মার তীর ঘেঁষেই বাংলার মানুষের কৃষ্টি, রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির বুনিয়াদ গড়ে উঠেছে। পদ্মার আর এক নাম কীর্তিনাশা। পদ্মা পাড়ের গৌরবময় কীর্তির সর্বনাশের ইতিহাসের কারণে ‘কীর্তিনাশা’ নামকরণ হয়েছে। পদ্মার এই কীর্তিনাশা নামকরণের পিছনে চাঁদ রায়, কেদার রায় ও রাজবল্লবের কীর্তির সর্বনাশের ইতিহাস জড়িত আছে। বাংলার বারো ভূঁইয়ার অন্যতম চাঁদ রায়, কেদার রায়ের রাজধানী ছিল বিক্রমপুরের শ্রীপুর নামক প্রাচীন নগরীতে। এখানে ছিল সুন্দর কারুকার্যখচিত প্রাসাদ, সেনানিবাস, বিচারালয়, কারাগার, কোষাগার ইত্যাদি। অন্যদিকে রাজবল্লবেরও সুশোভিত রাজনগর ছিল।

১৭৮৭ সালে তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র মিলিত হয়ে গঙ্গার সাথে মিশে পদ্মার মহাপ্লাবনে চাঁদ রায় ও কেদার রায়ের নয়নাভিরাম শ্রীপুর ও রাজবল্লবের সুশোভিত রাজনগর মুহূর্তেই তছনছ হয়ে গেলে, প্রমত্তা পদ্মা এসব কীর্তির নাশ করে কীর্তিনাশা নাম ধারণ করে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ‘সর্বনাশা পদ্মা’ বলে অভিহিত করেন। পদ্মা বা পদ্মাবতী নামের সাথে শ্রীচৈতন্যের পূর্ববঙ্গে আগমন ও পদ্মা নদীতে স্নানের যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। যদিও এ নিয়ে ভিন্নমতও পাওয়া যায়।

পদ্মা আমাদের অর্থনৈতিকভাবেও সমৃদ্ধ করেছে। কেবল মাত্র ২০১২-১৩ অর্থ বছরে নদী থেকে মৎস্য আহরিত হয়েছে প্রতি হেক্টরে ১৭২ কেজি। সেচ ব্যবস্থায় শুধুমাত্র গোদাবাড়ী উপজেলায় পদ্মা নদী থকে পানি উত্তোলন করে দুই হাজার-হেক্টর জমিতে সেচ প্রদান করা হয়, ২০১৩-১৪ অর্থ-বছরে নদী পরিবহণ খাতে জিডিপিতে অবদান রেখেছে .৬৩ শতাংশ যা টাকার অংকে ৮০৬৬৩ মিলিয়ন। গঙ্গা-পদ্মা বাহিত পলি-কাদা এ দেশের উর্বর শ্যামল ভূমির মূল সঞ্জীবনী। নদীবিধৌত এই পললভূমিতে কৃষির যে জয়যাত্রা সূচিত হয়ে আসছে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে অর্থনীতির হিসেব কষে তা নির্ণয় করা রীতিমতো দুঃসাধ্য ব্যাপার!

পদ্মা দুই অঞ্চলের মাঝে সংগ্রামী জীবনের সংযোগ স্থাপনকারী অনন্য এক স্রোতস্বিনী। পদ্মার উত্তর-পূর্ব প্রান্তে লৌহজং, মুন্সীগঞ্জ, দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলে শরীয়তপুর, মাদারীপুর অবস্থিত। দুই অঞ্চলের মানুষের মাঝে আত্মীয়তা গড়ে উঠা দীর্ঘদিনের। এক পাড়ের ছেলে, অন্য পাড়ের মেয়ের বিবাহবন্ধন, দুই আলাদা সংস্কৃতির মিলনক্ষেত্র এ পদ্মা নদী। দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পদ্মার উপর সেতু নির্মাণ যেন অকল্পনীয় এক স্বপ্ন। জীবন চলার পথে অধিকাংশ স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এই অঞ্চলের হাজার বছরের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছেন – একটি ভাষা, একটি জাতি, একটি পতাকা, একটি জাতীয় সংগীত, একটি দেশ-বাংলাদেশ। অনেক সংগ্রাম, আত্মত্যাগ, সম্ভ্রম ও রক্তের বিনিময়ে একটি স্বাধীন দেশ রচিত হয়েছে বাঙালির মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে।

পদ্মা সেতু – আমাদের স্বপ্নের সেতু, অহংকারের সেতু, মর্যাদার সেতু, স্বনির্ভরতার সেতু, মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার সেতু, প্রতিশোধের সেতু, ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে দৃপ্ত প্রত্যয়ে এগিয়ে যাবার সেতু। একটি কল্পনা প্রসূত স্বপ্নের অকল্পনীয় বাস্তবায়ন। আমাদের দেশের তথাকথিত রাজনীতিক বা সুশিল সমাজের ধ্বজাধারী, অর্থনীতিবিদ, গবেষক ঘোষণা দিয়েছেন – নিজের টাকায় পদ্মা সেতু এক বিলাসী স্বপ্ন, বিশ্ব ব্যাংকব্যতীত এই সেতু নির্মাণ কখনোই সম্ভব নয়, নির্বাচনী চমকের ওয়াদামাত্র ইত্যাদি ইত্যাদি।

পদ্মা সেতু – বাস্তবায়নে দীর্ঘ পরিক্রমায় ভাবনা, আলোচনা করা, স্বপ্ন দেখা, সমীক্ষার পর সমীক্ষা, বার বার বাজেটের পরিবর্তন, নকশার পরিবর্তন, পরিবর্ধন, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত, ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন নিয়ে মিথ্যা বিতর্ক, দুর্নীতির অভিযোগে বাংলাদেশ অভিযুক্ত করে উদ্ভূত যোগাযোগ মন্ত্রীর অপসারণ, যোগাযোগ সচিবের কারাবরণ, অর্থ উপদেষ্টার ও দুদকের উপর চাপ, বিধিবহির্ভূত বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টের শেষ কর্মদিবসে ঋণ চুক্তি বাতিল, মালেশিয়ার ঋণের এবং সেতু নির্মাণের প্রস্তাব, চীনের আগ্রহ, কানাডিয়ান আদালতে মামলায় বাংলাদেশের কোন দুর্নীতির প্রমাণ না মেলা, পশ্চিমা বিশ্বের জোটবদ্ধ অবস্থান, সর্বাপরি রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার হার না মানা প্রত্যয় সব নেতিবাচকতাকে ভণ্ডল করে দিতে সক্ষম হয়।

সকল বিরোধীতা, ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে অপরিমেয় সাহসে বলিষ্ঠ পদক্ষেপে এগিয়ে গেলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। তিনি স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্ন দেখান, স্বপ্ন বুনেন, স্বপ্নের বাস্তবায়ন করেন। শেখ হাসিনা একজন স্বপ্ন দেখা ও তা বাস্তবায়ন করা বিস্ময়কর এক রাষ্ট্রনায়ক।

আমরা দেখতে পাবো, ৪ জুলাই ২০০১ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মার মাওয়া ও জাজিরার দুই পাড়ে পদ্মা বহুমুখী সেতুরভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। জাইকা ২০০৩-২০০৫ সালে তাদের নিজস্ব অর্থায়নে আবারও সমীক্ষা চালায়। তৎকালীন বিএনপি-জামাত সরকার ২০০৫ সালে ডিপিপি অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হলেও এ ব্যাপারে কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি, ২০০৭ সালে ওয়ান ইলেভেন সরকার ১০,১৬১ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন করেন।

শেখ হাসিনার সরকার আবার ক্ষমতায় আসলে মাত্র ২২ দিনের মাথায় পূর্ণাঙ্গ নকশা প্রণয়নে নিউজিল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘মনসেল এইকম’- কে নিয়োগ দেওয়া হয়। শুরুতে ‘রেল সুবিধা’ আলাদা ভাবে যুক্ত ছিল না, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই প্রথম যুক্ত করেন। ২০১০ সালে নকশা চূড়ান্ত করে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করেন এবং সেখানে ৪০টি কোম্পানি অংশগ্রহণও করে।

২০১০ সালে ডিপিপি সংশোধন করে ব্যয় ধরা হয় ২০৫০৭ কোটি টাকা। ৪০টি কোম্পানির মধ্যে বিশ্বব্যাংক, জাইকা, এডিবির তত্ববধানে ৫ টি কোম্পানিকে বাছাই করে। ২০১১ সালে বিশ্বব্যাংক, এ ডি বি, আই ডি বি ও জাইকার সঙ্গে বাংলাদেশ ঋণ চুক্তিতে সই করেন। ষড়যন্ত্র শুরু, যদিও একটি টাকাও পাচার হয়নি, সেখানে বিশ্বব্যাংক একটি ডায়েরিতে ঘুষের টাকা উল্লেখিত আছে বলে বাংলাদেশের বিরুদ্দে দুর্নীতির অভিযোগ বিশ্বব্যাপী প্রচার করে। এতে বাংলাদেশের নোবেল বিজয়ী ডঃ ইউনুসের জড়িত থাকার অভিযোগের প্রমাণ বিদেশে ই-মেইল পাঠানো সহ অনান্য তথ্যাদি দুদকের কাছে সংরক্ষিত আছে বলে জানা যায়।

বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জোয়েলিক তাঁর শেষ কর্মদিবসে ঋণ চুক্তি বাতিল করে সাক্ষর করেন। সাক্ষর করার কিছু সময় আগে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট এর রুম থকে তিনজন বিশিষ্টব্যক্তি বেরিয়ে হয়ে আসেন, যারা ওয়ান ইলেভেন এর কুশীলব নামে খ্যাত। এটা কোন ষড়যন্ত্র, দেশদ্রোহীতা, না সৌজন্যবোধ সে প্রশ্ন জাতির কাছে, ইতিহাসের পাতায় থেকেই যাবে। মনে রাখতে হবে ইতিহাস অমোচনীয় কালি-কিছু সময়ের জন্য ঢেকে রাখা যায়, সব সময়ের জন্য উন্মুক্তই থেকে যায়। দূরদর্শী সাহসী রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা ২০১২ সালের ৯ জুলাই নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু হবে, মন্ত্রী পরিষদে অনুমোদন দেন।

২০১২ সালের ৯ জুলাই বাঙালির আর একটি সাহসী মর্যাদার দিন। অবাক বিস্ময়ে বিশ্ব তাকিয়ে থাকে শেখ হাসিনা এই ঐতিহাসিক সাহসী ঘোষণায়। হতবাক বিশ্বব্যাংক, অপ্রতিরোধ্য শেখ হাসিনার বাংলাদেশ। দুর্নীতির অভিযোগে শেখ হাসিনা যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিলেন – বিশ্বব্যাংক থেকে দুর্নীতির প্রমাণ চেয়েছেন, দুদককে তদেন্তের নির্দেশ দিলেন, অভিযুক্ত মন্ত্রীকে অপসারণ করলেন, কানাডার আদালতে মামলা দায়ের করেন। আর্থিক প্রস্তাবনা গৃহীত হওয়ায় চায়না আন্তর্জাতিক দরপত্রে রেলওয়ে গ্রুপ লিঃ এর আওতাধীন চায়না মেজোর ব্রিজ ইঙ্গিনিয়ারিং কে সেতু বিভাগ কার্যাদেশ প্রদান করেন।

২০১৪ সালের ১৭ জুন চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে চুক্তি সাক্ষরিত হয়। ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হয়। চীনের চুক্তির আগে মালয়শিয়ার পদ্মা সেতু নির্মাণে প্রস্তাব পেশ করেন যা ছিল অত্যন্ত ব্যায়বহুল। ২০১৬ সালে আবার ও ৮২৮৬ কোটি টাকা ব্যায় বেড়ে মোট ২৮৭৯৩ কোটি টাকা দাঁড়ায়। ২০১৮ সালে আবার ব্যায় বর্ধিত হয়ে প্রকল্পের মোট ব্যায় ৩০১৯৩ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এর পুরো টাকাই সরকারি অর্থায়নে এ সেতু নির্মাণ হয়েছে, প্রকল্পের মেয়াদ কাল ধরা হয়েছে, ১ জানুয়ারি ২০০৯ থেকে ৩০ জুন ২০২৩ পর্যন্ত, অর্থাৎ ১৪ বছর।

মূলতঃ ৭ ডিসেম্বর ২০১৪ সালে কাজ শুরু হয়ে ২৫ জুন ২০২২ সালে কাজ সমাপ্ত হওয়ায় পদ্মা সেতু নির্মাণে ৭ বছর সময় লেগেছে। সর্বশেষ নকশা প্রণয়নকারী আমেরিকান মাল্টিন্যশানাল ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মের (AECOM) নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পরামর্শকদের নিয়ে গঠিত একটি দল, পদ্মা সেতু দ্বিতল বিশিষ্ট, উপরে সড়ক পথ চার লেন, নীচে রেলপথ এক লেন, সেতুর দৈর্ঘ্য – ৬.১৫ কিলোমিটার, প্রস্থ – ১৮.১০ মিটার (৭২ ফুট), প্রধান উপকরণ ইস্পাত ও কংক্রিট।

আমরা জানি, একটা রাজনৈতিক দলের মিথ্যাচার, গুজব ও ষড়যন্ত্র পদ্মা সেতু নির্মাণে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে বার বার। গুজবের ছড়াছড়ি – পদ্মা সেতু নির্মাণে মানুষের মাথা লাগবে, শিশুর মাথা লাগবে। তাই ছেলেধরা সন্দেহ, অপহরণকারী সন্দেহে গণধোলাই, হত্যা ইত্যাদি। পিলার ভেঙ্গে যাবে, একটা দলের প্রধান – ‘পদ্মা সেতুতে উঠলে পদ্মা সেতু ভেঙ্গে যাবে’ বলে গুজব ছড়ান। বিগত দিনে ও এমন গুজব আমরা অনেক শুনেছি, এমনকি চাঁদে সাঈদীকেও দেখা গেছে, সাম্প্রদায়িকতার গুজবে অগ্নিসংযোগ, ধ্বংসলীলা চালাতে দেখেছি, ছাত্রদের ধর্মঘটে ও গুজবের ভিডিও প্রদর্শিত হয়েছে, কোভিড ভ্যাকসিন তো বুড়িগঙ্গার পানি! প্রধানমন্ত্রীকে আগে নিতে বলেন, তারপর আমরা নেব।

চিলে কান নিয়ে গেল, কান ঠিকই কানের নির্দিষ্ট স্থানেই আছে, এদেশের জনগণ অনেক মিথ্যাচারের রাজনীতি দেখেছে, স্বাধীনতার ঘোষক, ড্রামতত্ত্ব – ড্রামের উপর দাঁড়িয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে মসজিদে উলুর ধ্বনি শোনা যাবে, কুকুরের মাথায় টুপি পরিয়ে মিথ্যাচারের শেষ নাই। হেফাজতের সমাবেশে শত শত মৃত্যু, একটা মৃত্যুরও প্রমাণ মেলে নি! ওআইসি সন্মেলনে প্রথম কে গেলেন – বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, ইসলামিক ফাউন্ডেশান কে প্রতিষ্ঠা করলেন, বঙ্গবন্ধু, সারাদেশে মডেল মসজিদ কে বনালেন, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। এবার নতুন মিথ্যাচার খালেদা জিয়া পদ্মা নদীর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছেন – মির্জা ফখরুল বললেন।

তখনকার যোগাযোগ ব্যারিস্টার মওদুদ সাহেব বললেন কোন ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হয়নি। আজকে ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। পদ্মা সেতু নির্মাণে পরামর্শক হিসাবে তার অবদান অনস্বীকার্য। জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেছিলেন – জাপানিরা প্রস্তাব করেছিল, মাঝের লেনে রেল গাড়ী, দুই পাশে মোটর গাড়ী, কিন্তু ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত নিলেন দোতলা সেতু হবে, রেল থাকবে নীচে, মোটর গাড়ী ওপরে। সমীক্ষায় দেখা গেল, আগামী ১০০ বছরে পদ্মার তলদেশের মাটি ৬২ মিটার পর্যন্ত সরে যেতে পারে। যমুনায় ৬৫ মিটার নীচে পাথরের স্তর পাওয়া গেছে। পদ্মার তল অতল, এখানে ৬২ মিটার ঝুঁকি পূর্ণ হওয়ায় এটা পরিবর্তন করে ১২২ মিটার পর্যন্ত পাইলিং করতে হয়েছে, বিশ্বের গভীরতম পাইল এটি।

প্যানেল বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেছেন, নদীর স্রোত ধারার জন্য ডিজাইন পরিবর্তন করতে হয়েছে। এতে ব্যয় বেড়েছে। সময়ও বেশী লেগেছে। পিলার বসেছে ৫০ মিটার অন্তর অন্তর। টেস্ট বা সমীক্ষা পর্যায়ে নদীর তলদেশের সম্ভব্য সব ঝুঁকি বোঝা যায়নি। বড় নির্মাণে এমনটি হয়ে থাকে, কাজ যত এগোতে থাকে ডিজাইনেও সমন্বয় সাধন করতে হয়।

পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি হয়েছে, ব্যয় বৃদ্ধি করে টাকা লোপাট করেছে, পদ্মা সেতু ভেঙ্গে পড়বে, পিলারে পাইলিং এ সমস্যা হলে খুশির সীমা নেই, এ সেতু কখনোই নিজের টাকায় বানাতে পারবেনা, গুজব ছড়ানো, টিকা-টিপ্পনী, ষড়যন্ত্র, দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার, সরকারের বিরুদ্ধে কোটি টাকার লবিস্ট নিয়োগ – হায় সেলুকাস কি বিচিত্র এই দেশ! দুর্নীতির মিথ্যা কল্পিত ‘অভিযোগ’ উত্থাপিত না হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃপ্তপ্রত্যয়ে সাহসী এই ঐতিহাসিক পদক্ষেপ হয়তো নিতেন না। তাই একটি প্রবাদ বাক্য বার বার মনে পড়ছে – চক্রান্তকারীদের অপতৎপরতা আজ ‘শাপে বর’ হয়ে ধরা দিয়েছে। বুমেরাং হয়ে গেছে দেশি-বিদেশি হীন চক্রান্ত। চিরকালের মতো চক্রীরা জনগণের কাজে অভিশপ্ত হিসেবেই প্রতিভাত হবেন।

২০১২ সালের ২৯ জুন বিশ্বব্যাংক বিশ্বকে জানিয়ে দেন, বাংলাদেশ পদ্মা সেতু নির্মাণে দুর্নীতি হয়েছে, তাদের হাতে প্রমাণ আছে। এসএনসি লাভালিন ও বাংলাদেশ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির মধ্যে এ দুর্নীতির ষড়যন্ত্র সংগঠিত হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি গোল স্টেইন এক বিবৃতিতে বলেন, ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ঋণ পেতে হলে অনেক ধরনের আরোপিত শর্তের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। অথচ ২১৯ কোটি ডলার প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়ার কথা মাত্র ১২০ কোটি ডলার, এডিবি, আইডিবি ও জাইকা দেয়ার কথা অবশিষ্ট ডলার। বিশ্বব্যাংকের চুক্তি বাতিল করা হলো।

অবশেষে কানাডিয়ান সুপিরিয়র আদালতের বিজ্ঞ বিচারক ইয়ান নদেইমার ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ পদ্মা সেতু নির্মাণে কোন প্রকার দুর্নীতির প্রমাণ পায়নি বলে রায় প্রদান করে। এটিও আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের সম্মান পুনরুদ্ধারের এক মাইলফলকও বটে। সর্বোপরি, আজ ২৫ জুন ২০২২ শনিবার আড়ম্বরপূর্ণ আযোজনে মহাকাব্যিক যে সেতুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন কেবলমাত্র একটি রাষ্ট্রের নিছক কোন অর্জনের দিনই নয়, বিশ্বের কাছে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার এক মাহেন্দ্রক্ষণ। আমরা উচ্চকণ্ঠে তাই এ উচ্চারণ করতেই পারি, বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল পরম্পরাকে সমুন্নত রাখতে আমরা ব্যর্থ হইনি।

আজ আমরা দ্বিধাহীনচিত্তে ঘোষণা করতেই পারি, রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা নামের সঙ্গে, ‘স্বাধীনতা, স্বার্বভৌমত্ব, স্বদেশপ্রেম ও স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়ার অভিপ্রায় যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু তর্জনী উঁচিয়ে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না।’ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে কলঙ্কিত ‘ওয়ান ইলেভেন’ দাবায়ে রাখতে পারেনি। তিনি মাথা নত করেননি। তেমনি পদ্মা সেতুকে ঘিরে সকল ষড়যন্ত্রেও তিনি মাথা নত করেন নি। গর্বিত উত্তরাধিকার নিয়ে তিনি মাথা নত করতে পারেন না। শেখ হাসিনার স্বপ্ন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আর বাঙালি জাতির স্বপ্ন আজ সমার্থক হয়ে উঠেছে। শেখ হাসিনার শক্তি এদেশের জনগণ। বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে যেমন বাংলাদেশ হতো না, তেমনি শেখ হাসিনার জন্ম না হলে কখনোই পদ্মা সেতু হতো না-এ আজ ধ্রুব সত্য হয়ে উঠেছে। পদ্মা সেতু শেখ হাসিনার ঐতিহাসিক অনন্য অর্জন। তাই আজ চারদিকে সমস্বরে উচ্চারিত হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু মানে বাংলাদেশ, বাংলাদেশ মানে শেখ হাসিনা। বাংলা ও বাঙালির জয় হোক। জয়তু শেখ হাসিনা।

লেখক-স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের যুগ্ম-মহাসচিব, উপদেষ্টা-ইতিহাস৭১.টিভি ও মাসিক ইতিহাস৭১

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on telegram
Telegram
Share on skype
Skype