বরন বড়ুয়া বাবু
আবদুল মান্নানের পৈতৃক বাড়ি #ব্রাহ্মণবাড়িয়া_জেলার_নবীনগর_উপজেলার_শ্যামগ্রাম ইউনিয়নের #নোয়াগাঁও গ্রামে। পাঁচ ভাই চার বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন চতুর্থ। তিনি অবিবাহিত ছিলেন। তার বাবার নাম #আবদুল_লতিফ এবং মায়ের নাম #রাবেয়া_খাতুন।
১৯৭১ সালের ৬ অক্টোবর চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্গত মদুনাঘাটে একটি অপারেশনে নেতৃত্বে ছিলেন আবদুল মান্নান। সাবস্টেশনের অবস্থান চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কের উত্তর পাশে এবং হালদা নদীর পশ্চিম পাশে। এখানে তখন তিনটি বড় ধরনের ট্রান্সফরমার ছিল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে ছিল পাকিস্তানি সেনা ও কিছু রাজাকার। সব মিলিয়ে ৩০-৩৫ জন। সাবস্টেশনের চারদিকে ছিল বাংকার। রাতে আবদুল মান্নানসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা রওনা হন লক্ষ্যস্থলে। তাদের দলনেতা ছিলেন সুলতান মাহমুদ (বীর উত্তম)। রাতে অন্ধকার তেমন গাঢ় নয়। আবছা অন্ধকারে দূরের অনেক কিছু চোখে পড়ে। তাই সবাই সতর্ক। সবার আগে একজন পথপ্রদর্শক। তার পেছনে দলনেতা ও আবদুল মান্নান। তাদের পেছনে সহযোদ্ধারা। সারিবদ্ধভাবে সবাই এগিয়ে যান। তাদের কাছে ভারী অস্ত্র মাত্র দুটি। একটি আরএল (রকেট লঞ্চার) ও একটি এলএমজি। অন্যান্য অস্ত্র এসএমজি, স্টেনগান ও রাইফেল। আর কয়েকটি হ্যান্ডগ্রেনেড। তারা সেদিন মদুনাঘাট বিদ্যুৎকেন্দ্রে (সাবস্টেশন) আক্রমণ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক অবস্থান ছিল মদুনাঘাটের অদূরেই। এর আগে তারা বিদ্যুৎকেন্দ্র এলাকায় রেকি করেন। নির্ধারিত দিন মধ্যরাতে তারা কেন্দ্রের ৫০-৬০ গজ দূরে অবস্থান নেন। রাত যখন তিনটা, তখন তারা আরএল দিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়েকটি রকেট ছোড়েন। নির্ভুল নিশানায় সেগুলো আঘাত হানে। তিনটি ট্রান্সফরমারেই আগুন ধরে যায়। পাকিস্তানি সেনারা সজাগই ছিল। সঙ্গে সঙ্গে তারা আক্রমণ চালায়। চারদিকের বাংকার থেকে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর বৃষ্টির মতো গুলি শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা আক্রমণ করেন। গুলির খই ফোটে বিদ্যুৎকেন্দ্রে। আবদুল মান্নান ও তার সহযোদ্ধারা সাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণ মোকাবিলা করেন। তুমুল যুদ্ধের একপর্যায়ে আবদুল মান্নান হঠাৎ গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তার বুকে কয়েকটি গুলি লাগে। সঙ্গে সঙ্গে নিভে যায় তার জীবনপ্রদীপ। শহীদ হন তিনি। সেদিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে তিনি শহীদ ও দলনেতা সুলতান মাহমুদসহ তিন-চারজন আহত হন। মদুনাঘাট বিদ্যুৎকেন্দ্র ধ্বংসের অপারেশন ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিরাট এক সাফল্য। তখন এই অপারেশনের খবর স্বাধীন বাংলা বেতারসহ বিদেশি বেতার ও খবরের কাগজে ব্যাপক প্রচার পায়। অবশ্য এই সাফল্য ছিনিয়ে আনতে গিয়ে আবদুল মান্নান শহীদ হন।
সহযোদ্ধারা আবদুল মান্নানের মরদেহ উদ্ধার করতে সক্ষম হলেও সমাহিত করতে পারেননি। তার মরদেহ তারা স্থানীয় #আবুরখীল গ্রামবাসীর কাছে রেখে আসেন। তারা মান্নানের মরদেহ ওই গ্রামেই সমাহিত করেন।
শহীদ আবদুল মান্নানের কবরটি রয়েছে #উরকিরচর_ইউনিয়নের_আবুরখীল_গ্রামের_উত্তর_ঢাকাখালীর_খালপাড়ে আমাদের বাড়ি থেকে শত গজ দহ্মিন দিকে। আবদুল মান্নান নিহত হয়েছিলেন মদুনাঘাটে সম্মুখযুদ্ধে। হালদা নদীর উভয় পাড়ে আশ্রয় নেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধযুদ্ধে শহীদ হন তিনি। #আবুরখীল_ছিল_মুক্তিযোদ্ধাদের_নিরাপদ_ঘাঁটি। এখানে বসেই প্রতিরোধযুদ্ধের পরিকল্পনা করা হতো। শহীদ মান্নানকে আহতাবস্থায় এখানে এনে বাঁচিয়ে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। স্বাধীনতার_পর_হতে_অদ্যাবধি_তাঁর_কবরটিকে_ঘিরে_আবুরখীল_গ্রামবাসীসহ_সরকারি_বেসরকারি_পর্যায়ে_বিভিন্ন_কর্মসূচি_পালন_করা_হয়। ছোটবেলা থেকেই তার বীরত্বগাথা শুনে আসছি। তিনি আমাদের দেশপ্রেমের অনুপ্রেরণা। তার কবরটি যথাযথ সংস্কারের জন্য কর্তৃপক্ষের সুদৃস্টি কামনা করছি।
তথ্যসূত্র
দৈনিক প্রথম আলো, “তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না” | তারিখ: ০৭-০৯-২০১২
একাত্তরের বীরযোদ্ধাদের অবিস্মরণীয় জীবনগাঁথা, খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা স্মারকগ্রহন্থ। জনতা ব্যাংক লিমিটেড। জুন ২০১২। পৃষ্ঠা ৪৭৭। আইএসবিএন 9789843351449।
একাত্তরের বীরযোদ্ধা, খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা (প্রথম খন্ড)। প্রথমা প্রকাশন। এপ্রিল ২০১২। পৃষ্ঠা ৩১৭। আইএসবিএন 9789843338884।