শুক্রবার-১৪ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-১লা ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-১৫ই শাবান, ১৪৪৬ হিজরি

প্রণোদনার ঋণ বাধাগ্রস্ত ব্যাংকের সক্ষমতার অভাবে

বাংলাদেশ ব্যাংক

নিজস্ব প্রতিবেদক : করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসা-বাণিজ্য পুনরুদ্ধারে প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে ঋণ বিতরণ কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সক্ষমতার অভাবে। ঘোষিত প্যাকেজ বাস্তবায়নে কম সুদে টাকা নিয়ে বসে আছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ঋণ দেয়ার লোক খুঁজে পাচ্ছে না। এদিকে নতুন গ্রাহকরা শর্তের বেড়াজালে পড়ে ব্যাংকের ধারে কাছেও ভিড়তে পারছেন না।

এ নিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কর্মকাণ্ডে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্টরা। তারা প্রণোদনা প্যাকেজগুলো বাস্তবায়ন না হওয়ায় ব্যাংকগুলোর সক্ষমতার অভাবকে দায়ী করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন, ব্যাংকার ও গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

এদিকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর পক্ষে বলা হয়েছে, প্রণোদনা ঋণ নিতে হলে গ্রাহকদের অনেক শর্ত মানতে হয়। এসব শর্ত বিশেষ করে ছোট ও নতুন গ্রাহকরা মানতে পারছেন না। যে কারণে ব্যাংক ইচ্ছে করলেও ঋণ দিতে পারছে না।

এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রণোদনার অর্থ ছাড় করাতে গেলেও বহুমুখী শর্ত পরিপালন করতে হয় গ্রাহক ও ব্যাংকগুলোকে। যে কারণে প্রণোদনার অর্থও ছাড় করানো সম্ভব হচ্ছে না।

এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বড় বড় প্রণোদনা প্যাকেজ দেয়া হলেও ব্যাংকগুলোর সক্ষমতা বাড়ানো হয়নি। যে কারণে তারা ঋণ দিতে পারছে না। ব্যাংকগুলো পুরোনো গ্রাহকদের ঋণ দিয়েই নিজেদের দায়িত্ব শেষ করেছে।

নতুন গ্রাহকদের দিচ্ছে না। অথচ ব্যাংকগুলোর দায়িত্ব হচ্ছে সম্ভাবনাময় নতুন উদ্যোক্তা খুঁজে তাদের ঋণ দেয়া। শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য বিকাশে সহায়তা করা। কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্র তৈরি করা। সক্ষমতার অভাবে ব্যাংক সেটি পারছে না।

তিনি জোর দিয়ে বলেন, যে কোনো অর্থনৈতিক সংকটের সময় ব্যাংকগুলো যাতে এগিয়ে আসতে পারে সেজন্য তাদের সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, করোনার প্রভাব মোকাবিলায় সরকার ১ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকার ২১টি প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। যা দেশের মোট জিডিপির ৪ দশমিক ৩ শতাংশ। এর মধ্যে ১১টি রয়েছে ঋণনির্ভর প্রণোদনা প্যাকেজ।

এতে মোট তহবিলের পরিমাণ ১ লাখ ২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দিয়েছে ৬৩ হাজার কোটি টাকা। সরকার দিয়েছে ৯ হাজার কোটি টাকা। বাকি ৩০ হাজার কোটি টাকা দিচ্ছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো।

ফেব্রুয়ারি এসব প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে বিতরণ করা হয়েছে ৫৬ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা। যা মোট প্যাকেজের ৫৬ শতাংশ। বাকি ৪৪ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়নি। প্যাকেজগুলোর মধ্যে ঋণ নির্ভর ১০টি সরাসরি বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে।

একটি পরিচালিত হচ্ছে পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ), কর্মসংস্থান ব্যাংক, পল্লী উন্নয়ন ব্যাংক ও সমবায় ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে। বড় শিল্প ও সেবা খাতে চলতি মূলধন ঋণ জোগানের জন্য প্রথমে ৩০ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হয়।

এরপর এর পরিমাণ আরও তিন হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে ৩৩ হাজার কোটি টাকা। এরপর আরও এক দফায় বিদেশি কোম্পানিগুলোর জন্য ৭ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে মোট ৪০ হাজার কোটি টাকা করা হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক দিচ্ছে ২৫ হাজার কোটি টাকা।

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো দেবে ১৫ হাজার কোটি টাকা। সাড়ে ৪ শতাংশ সুদে দেয়া এ ঋণের মধ্যে বড় শিল্প ও সেবা খাতে চলতি মূলধন হিসাবে দেয়া হয়েছে ২৯ হাজার কোটি টাকা। বাস্তবায়নের হার ৯৭ শতাংশ।

অর্থনৈতিক অঞ্চলে অবস্থিত বিদেশি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের জন্য গঠিত ৭ হাজার কোটি টাকার তহবিলের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে ১১০ কোটি টাকা। বাস্তবায়নের হার ১ দশমিক ৫৮ শতাংশ।

রপ্তানিমুখী শিল্পের শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন ভাতা প্রদানে ৫ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হয়। এ অর্থ বিতরণ হয়ে গেলে আরও অর্থের প্রয়োজন হয়।

তখন বড় শিল্প ও সেবা খাতের তহবিল থেকে আরও ৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ অর্থও বিতরণ করা হয়েছে। ২ শতাংশ সার্ভিস চার্জের বিনিময়ে দেয়া এ প্যাকেজটি শতভাগ বাস্তবায়ন হয়েছে।

কুটির, অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের (সিএমএসএমই) চলতি মূলধন ঋণ জোগানোর জন্য গঠিত ২০ হাজার কোটি টাকার তহবিল থেকে বিতরণ হয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা। বিতরণের হার ৬০ শতাংশ। এসব অর্থ প্রায় সবই মাঝারি শিল্পে বিতরণ করা হয়েছে।

কুটির, অতি ক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র শিল্পে ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করেনি বললেই চলে। এতে গ্রাহক পর্যায়ে সুদ হার ৪ শতাংশ। এ তহবিলে কেন্দ্রীয় বাংক ১০ হাজার কোটি টাকা এবং ব্যাংকগুলো দিচ্ছে ১০ হাজার কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, এ প্যাকেজের মাধ্যমে গ্রামীণ ছোট ছোট উদ্যোগে অর্থের প্রবাহ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়। যে কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও এটি বাস্তবায়নে ব্যাংকগুলোর ওপর ব্যাপক চাপ প্রয়োগ করা হয়। চার দফায় এর মেয়াদ বাড়িয়ে ৩১ মার্চ পর্যন্ত করা হয়। কিন্তু তারপরও প্যাকেজটি বাস্তবায়ন নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

বেসরকারি ব্যাংকের একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বলেন, ঋণ দেয়ার আগে শতবার চিন্তা করতে হয় এটি ফেরত আসবে কিনা। যদি দেখি ঝুঁকি আছে তখন কেউ ঋণ দিতে চায় না।

প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) আকার ৩৫০ কোটি ডলার থেকে ১৫০ কোটি ডলার বা ১২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার বাড়িয়ে ৫০০ কোটি ডলার বা ৪২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা করা হয়।

একই সঙ্গে ঋণের সুদের হার দুই দফায় কমিয়ে পৌনে ২ শতাংশ করা হয়। এর মধ্যে বিতরণ হয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা। বিতরণের হার প্রায় ৭৮ শতাংশ। এ তহবিল থেকে শুধু পণ্য রফতানির জন্য কাঁচামাল আমদানির জন্য ঋণ দেয়া হয়।

পুরো তহবিলে রিজার্ভ থেকে অর্থায়ন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। রপ্তানি শিল্পের পণ্য প্রাক-জাহাজীকরণের জন্য ৫ হাজার একটি পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করা হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব অর্থে। এ তহবিল থেকে ঋণ বিতরণের শর্ত দুই দফায় শিথিল করা হয়েছে। তারপরও ঋণ বিতরণ বাড়ছে না।

ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এ তহবিল থেকে ঋণ বিতরণ হয়েছে ১৪৫ কোটি টাকা। বাস্তবায়নের হার ২ দশমিক ৯ শতাংশ। সুদের হার ৭ শতাংশ। কঠিন শর্তের কারণে গ্রাহকরা এ তহবিল থেকে ঋণ নিতে আগ্রহী নন বলে জানান ব্যাংকাররা।

এ বিষয়ে রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, ঋণের শর্ত কঠিন বলে অনেক গ্রাহকই নিতে চান না। কিছু ঋণ নিতে হতে অডিট রিপোর্ট দিতে হয়। অনেক প্রতিষ্ঠানের এ রিপোর্ট নেই। তিনি ঋণ বিতরণ প্রক্রিয়াকে সহজ করার দাবি করেন।

কৃষিভিত্তিক শিল্পে ঋণ দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব অর্থায়নে ৫ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিলের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা। বাস্তবায়নের হার ৭০ শতাংশ। সুদের হার ৪ শতাংশ।

করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের গত বছরের এপ্রিল ও মে এই দুই মাসের ঋণের সুদ মওকুফ করা হয়। এ জন্য ব্যাংকগুলোকে সুদ ভর্তুকি দিতে সরকার ২ হাজার কোটি টাকার তহবিল বরাদ্দ দেয়।

এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিতরণ করেছে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। বাস্তবায়নের হার ৮০ শতাংশ। সুদ মওকুফের সুবিধা পাওয়ার জন্য ব্যাংকগুলো থেকে যথাযথভাবে আবেদন আসেনি বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ছাড় করতে পারছে না।

করোনার ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ক্ষুদ্রঋণ খাতে বিতরণের জন্য ৩ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ৯ শতাংশ সুদে মাঠপর্যায়ে ঋণ দেয়া হচ্ছে। এই তহবিল থেকে ২ হাজার কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। বাস্তবায়নের হার ৬৭ শতাংশ।

বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ঋণ বিতরণ করতে ২ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল গঠন করেছে সরকার। এর মধ্যে পিকেএসএফ, কর্মসংস্থান ব্যাংক, পল্লী উন্নয়ন ব্যাংক ও সমবায় ব্যাংকের অনুকূলে ইতোমধ্যে ১ হাজার কোটি টাকা দেয়া হয়েছে।

বাস্তবায়নের হার ৫০ শতাংশ। এর সুদের হার ৪ শতাংশ। এর বাইরে চলতি অর্থবছরে কৃষি ও পল্লি ঋণ কর্মসূচির আওতায় ২৬ হাজার ২৯২ কোটি টাকার ঋণ কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। ব্যাংকগুলো নিজস্ব অর্থে এসব ঋণ বিতরণ করবে।

তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে চাইলে অর্থ পাওয়া যাবে। এর আওতায় ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। বিতরণের হার ৪৬ শতাংশ।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on telegram
Telegram
Share on skype
Skype